Bangla
2 years ago

ঢাকাইয়া আড্ডা: এক চিরন্তন মোহের নাম

Published :

Updated :

ঢাকার আড্ডার প্রাঞ্জলতার কেচ্ছা যেন ঘুরে-ফিরে তরূণদের মুখে মুখে। শব্দ দূষণ আর ধুলো-ময়লার জনবহুল এ শহরের আড্ডায় কি যেন এক মায়া আছে যা ঢাকার অলিগলিতে আড্ডাবাজা মানুষ মাত্রই ভালোবাসে। 

টং দোকানে এক কাপ চা হাতে পরিচিত মানুষের সাথে আড্ডা বহুকাল ধরে চলে আসছে। এসব আড্ডায় চায়ের চুমুকে প্রতিনিয়ত বদলে দেওয়া হয় সমাজকে। আড্ডায় থাকে সব বয়সের আর পেশার মানুষের মতের বৈচিত্র্যতা।

অন্তু দাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগের মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টারে পড়াশোনা করছেন। তার ভাষ্যে তাদের আড্ডার মূলে থাকে প্রাত্যহিক জীবন-সংগ্রামের টুকরো টুকরো ছবিগুলো।

“আজকেই আমার টিউশনের টাকা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পেতে সময় লাগছে বলে আর কিছু দিন একটু হিসেব করে চলতে হবে। এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই আড্ডা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যায়। আমার বন্ধুরা তাদের বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে। মাঝে মাঝে এক কাপ চা হাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়।”

অন্তুর কথার সাথে যোগ করেন তার স্কুলের বন্ধু সুদয় সাহা, পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “আড্ডার কোনো বিশেষ বিষয় থাকে না। আমরা একজন আরেকজনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে একই জায়গায় প্রতিদিন এসে উপস্থিত হই। সারাদিনের ব্যস্ততা আর ক্লান্তি শেষে বাসায় ফেরার আগে এক কাপ চা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিলে দিন সম্পন্ন হয় না বলে আমার মনে হয়।”

“মাঝেমধ্যে কাবাবের দোকানগুলোতেও গ্রিল চিকেনের বিনিময়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে আমাদের আড্ডা,” আরো যোগ করেন সুদয়।

ইসমাইল শেখ নয়ন বর্তমানে সলিমুল্লাহ কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি জানান তাদের আড্ডা হয় ওয়ারির রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে। হেয়ার স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট,‌ লারমিনি স্ট্রিট হয়ে নারিন্দা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয় সেসব। 

“যখনই সুযোগ পাই তখনই আমি ও আমার বন্ধুরা আড্ডা দিতে বের হই,” বলেন নয়ন।

“আমরা বিশ্বাস করি আড্ডা দিলে ভারি মন  হালকা হয়, মনের জড়তা কাটে এবং বিষণ্নতা দূর হয়। আমাদের বয়সীরা হরহামেশাই বিষণ্নতায় ভোগে, তা দূর করার জন্য আমাদের তেমন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দিনশেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে আমার মন ভালো থাকে, আমি সুস্থ অনুভব করি।”

হাঁটতে হাঁটতে আড্ডা দিলে আড্ডায় ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায় বলেই জানান নয়ন। তাছাড় নারিন্দার গাছগাছালি পূর্ণ স্কুলের গলির নিরিবিলি পরিবেশ এমন যে সেখানে কিছু সময় বসে নিশ্বাস নিলেই মন ভালো হয়ে যায়। নয়নের জন্য এই পরিবেশ, বন্ধু এবং আড্ডা ধ্যানের (মেডিটেশন) মতো।

“আড্ডা মন ভালো রাখে,”  নয়নের কথায় সুর মিলিয়ে বলেন মোঃ সজল আহমেদ। সজল ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএতে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে পুরান ঢাকায় হার্ডওয়ারের ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। 

সজল মনে করেন, আড্ডা মন ভালো রাখা এবং শান্তিতে থাকার জন্য খুবই জরুরী। তিনি তার বিভিন্ন বন্ধুদের সাথে ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেই আড্ডা দেন, তবে তার পছন্দের জায়গা হল পুরান ঢাকা।  

“আমরা সব কথা তো পরিবারের কাছে বলতে পারি‌ না। তবে বন্ধুদের সাথে কোন বাধা থাকে না; আমরা যেকোনো বিষয়ে, যেভাবে ইচ্ছা বলতে পারি।”

আড্ডার কোন নির্দিষ্ট বিষয় বস্তু থাকে না। প্রযুক্তিতে কেমন পরিবর্তন এসেছে, দেশে-বিদেশে কী হচ্ছে থেকে শুরু করে তারকাজগত- সব কিছু নিয়েই খোলামেলা আলাপ হয়ে থাকে আড্ডায়।

সজল বিশ্বাস করেন আড্ডার আর বন্ধুত্বের মাঝে ভাষা, ধর্ম, লিঙ্গ - কোনো কিছুই গুরুত্ব রাখে না, বরং আস্থা এবং ভরসার জায়গাটিই প্রাধান্য পায় বেশি।

ঢাকার আড্ডার এক তীর্থস্থান যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষের ভীড় জমে এখানে প্রতিদিনই; মেতে ওঠে আড্ডায়। মানুষের শোরগোলের সাথে শোনা যায় গিটারের টুংটাং শব্দ। সবকিছু মিলিয়ে ভিন্ন এক পরিবেশে আড্ডা জমে উঠে টিএসসিতে।

টিএসসিয়ের আড্ডা প্রসঙ্গে সুদয় সাহা বলেন, “প্রতি শুক্রবার আমি টিএসসিতে আসি। শুক্রবারে টিএসসিতে আশা আমার পরিকল্পনারই অংশ। গরম-গরম দুধ চা, মাল্টা চা, মামার ফুচকা আর গিটার, উকুলেলের টুং টাংয়ে আমার দিনের শেষটা বেশ আনন্দের হয়।”

সুদয়ের আড্ডাটা আরো জমে ওঠে সবাই কাছাকাছি বয়সের হওয়ায়। “এলাকার আড্ডাতে স্বাভাবিকভাবেই একটু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, মেপে কথা বলতে হয়। টিএসসিতে আড্ডার সময় এতো মাপজোখের প্রয়োজন হয় না, নির্দ্বিধায় আড্ডা দেয়া যায়; পরিবেশটাই আড্ডা সহায়ক," ব্যাখ্যা করেন তিনি। 

টং দোকানের বিশেষত্ব আছে। তবে টিএসসি'র চায়ের দোকানগুলোর রেলিংয়ে বসে দেখা রাজু ভাস্কর্য, চায়ের কেটলি থেকে ধোঁয়া ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিশে যাওয়া, একদিকে শাহবাগ, বিপরীতে বাংলা একাডেমি ও শহীদ মিনার, আরেক দিক রোকেয়া হল হয়ে ফুলার রোড, মাঝ পথে ল্যাম্প পোস্টের আলোতে চকচকে রাস্তা, মানুষের ভীড় - সবকিছু মিলে টিএসসি জমপেশ আড্ডার স্বর্গ। 

সময়ের বিবর্তনে মানুষের মাঝে পরিবর্তন আসলেও আড্ডার আনন্দ, ভালো লাগা, স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গাটি পরিবর্তন হয়নি।

ঠিক তেমনি পরিবেশ-প্রকৃতি আর অবকাঠামোয় পরিবর্তন আসলেও বন্ধুর অপেক্ষার ঘড়ি দেখা বদলে যায়নি।

গান-কবিতা ও তর্কের মোড়কে গরম গরম-গরম চায়ের ধোঁয়ার সাথে মিশে যায় সারাদিনের ক্লান্তিগুলো, যার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় ‘ঢাকাইয়া’ আড্ডার গন্ধ।

 

মোঃ ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। 

[email protected]

Share this news