Bangla
2 years ago

সুনডোকু: বইয়ের পর বই জমেছে, কিন্তু নেই পড়ার আগ্রহ

সুনডোকু ব্যক্তিরা বই কেনেন, কিন্তু না পড়ে জমিয়েই রাখেন।  ছবি: টুইটার
সুনডোকু ব্যক্তিরা বই কেনেন, কিন্তু না পড়ে জমিয়েই রাখেন। ছবি: টুইটার

Published :

Updated :

বহুদিন ধরে খুঁজে চলেছেন একটি বই৷ বারবার মনে হচ্ছে, ইশ! এখনি যদি পড়া যেতো! এক বৈঠকে পুরো বইটা শেষ করে ফেলতেন! 

এরপর সময় চলে যায়। একসময় বইটি হাতে আসে। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখা গেলো সেই উত্তেজনা আর কাজ করছে না৷ যেন কোথাও কেটে গেছে সুতো, চলে এসেছে ক্লান্তি। তাই কয়েকপাতা পড়েই রেখে দেয়া হলো বইটি; পুরোটা আর শেষ হলো না।

একসময় হয়তো হন্যে হয়ে খুঁজেছেন কোনো সিনেমা, রক্ষ্মণশীল পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে হলে যাবার গল্পও আছে বিস্তর। কিন্তু একসময় মিস করে ফেলা সেই সিনেমা হয়তো পরে আর ডিভিডিতে বা টিভি চ্যানেলে দেখালেও আর আগ্রহবোধ হয়নি।

হয়তো এখন পরীক্ষার ব্যস্ততার কারণে প্রিয় ওয়েব সিরিজটি দেখতে পারছেন না। কিংবা হাতে টাকা না থাকায় এখনই আপনার পক্ষে সাবস্ক্রিপশন কেনা সম্ভব নয়। তারপর একসময় সাবস্ক্রিপশন কেনা হলো, কিন্তু তখন এতো সুন্দর সব সিরিজও আর দেখতে ইচ্ছা করলো না।  

এভাবে একসময়ের তীব্র আকর্ষণ সময়ের সাথে সাথে স্তিমিত হয়ে যায়। বইয়ের ক্ষেত্রে, কেনা বইগুলো পড়ে থাকে, সেসবের ঘ্রাণ নেয়ার প্রয়োজনও বোধ হয় না। পিডিএফে ফাইলের পর ফাইল বই জমা হয়, ক্লিক করে সেসব আর পড়তেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু প্রচুর বই জমে থাকে।

এভাবে বই কিনে না পড়ে জমিয়ে রাখাকে বলা হয় 'সুনডোকু' (Tsundoku)। এটি একটি জাপানি শব্দ। 'সুন' অংশটি এসেছে জাপানি 'সুমু' থেকে, যার অর্থ স্তুপ আর 'ডকু' অর্থ বইপত্র।

অর্থাৎ, বই স্তুপ করে রাখাকে বলা হচ্ছে সুনডোকু।

জাপানি এক শিক্ষকের এমন অভ্যাসের প্রেক্ষিতে তার নাম হয়েছিলো 'সুনডোকু সেনসেই'। তিনি সব ধরনের বই কিনে এভাবে জমিয়ে রাখতেন, তবে বেশিরভাগই পড়তেন না।

এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৭৯ সালে। তখন জাপানে চলছে মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২)।

তবে এর সাথে অনেকে 'বিবলিওম্যানিয়া'- কে গুলিয়ে ফেলেন, যা এক নয়। ১৯২১ সালে এই শিরোনামে উপন্যাস লিখেছিলেন থমাস ফ্রগনাল ডিবডিন। 'বিবলিও' অর্থ বই, আর 'ম্যানিয়া' হলো অদম্য আকর্ষণ। এক্ষেত্রে পড়ার ইচ্ছা থাকা বা বইটির প্রতি ভালোবাসা মুখ্য নয়। যেকোনো মূল্যে বইটি শুধু সংগ্রহ করতে পারাটাই বোঝানো হয়। একেকজনের একেকরকম বিবলিওম্যানিয়া থাকতে পারে। অর্থাৎ, এটি বিশেষায়িত।

কারো হয়তো শুধু হরর বা থ্রিলার পছন্দ। কারো পছন্দ ইতিহাস বা রাজনীতি। আবার বিশেষ কোন লেখকের প্রতিও থাকতে পারে বিবলিওম্যানিয়া। তবে সুনডোকুতে যেরকম পড়ার একটি প্রছন্ন আগ্রহ থাকে, তবু পড়া হয়ে ওঠে না বা সেই প্রেষণা কাজ করে না; এখানে তেমন না। এখানে সংগ্রহের নেশাটাই মূল কথা।

সুনডোকু যাদের আছে, তারা একটি বই না পড়ে ফেলে রাখলেও হারিয়ে ফেললে অস্থির হয়ে পড়েন। ব্যাপারটির তুলনা হতে পারে কোনো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার সাথে। খুব ঘনিষ্ট কোনো সম্পর্ক একসময় পরিচর্যার অভাবে বা গুরুত্বের অভাবে ভেঙে যায়। কিন্তু হারিয়ে ফেলার পর আবার তাকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্খা তীব্র হয়ে উঠতে থাকে।

সুনডোকুও এমন। বই পড়ে আছে, পড়া হচ্ছে না। মাঝে মাঝে হয়তো এক পলকের জন্য চোখ পড়ে। কখনো কখনো হয়তো হাতে নিয়ে একটু দেখা হয়। কিন্তু বন্ধুর সাথে দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার মত বইও আর পুরোটা পড়তে ইচ্ছা করে না। সেলফে, টেবিলে, মেঝেতে তারা রয়ে যায় শুধু দর্শনীয় বস্তু হিসেবে, থেকেও না থাকার মতো।

মূলত কোনো বইয়ের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড আবেগ থেকে সৃষ্ট তীব্র আকর্ষণের ফলেই এই ব্যাপারটি ঘটে। হয়তো ফ্ল্যাপের কথাগুলো পড়ে মনে হয়, এই বইটা পড়তেই হবে। না পড়লে কিছু একটা ছুটে যাবে। কিন্তু একবার কিনে ফেলার পর আর সেই টানটি থাকে না। দীর্ঘ সংসারে যেমন ক্লান্ত হন অনেকে। প্রেমের সময়টায় পরিণতির জন্য শত বাধা-বিপত্তিও মানুষ পেরোতে চায়। কিন্তু সংসার জীবনে দীর্ঘদিন যাপনের পর একসময় সেই আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে, নির্লিপ্ত একরকম ভাব চলে আসে। এই ব্যাপারটি হয় বইয়ের সাথেও। পাঠকের কাছে বইও প্রেমিকার মত, বইও জীবনসঙ্গীর মত। তাই বই নিয়ে সুনডোকুদের থাকে এমন জমা করার অভ্যাস।

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী

[email protected]

Share this news