Bangla
14 days ago

কেন কমে যাচ্ছে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার?

Representational image
Representational image

Published :

Updated :

ফার্মগেটের ওভারব্রিজে বসে আছেন এক বয়স্ক ভিক্ষুক। উনাকে ২ টাকার একটি পয়সা দিয়ে নিজেকে উদার ভাবার আগেই ভিক্ষুক পয়সাটি ছুঁড়ে ফেললেন। রিক্সা দিয়ে নীলক্ষেত থেকে নিউমার্কেট এসে ২০ টাকা ভাড়ার জায়গায় রিক্সা মামাকে ৫ টাকা বাড়িয়ে দিলে উনি ৫ টাকার পয়সাটি না নিয়েই চলে গেলেন।

এই পয়সা যেন আজ কারোরই আর প্রয়োজন নেই। অথচ পয়সা সেই প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় প্রচলিত। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত বেশিরভাগ রাষ্ট্রে যেমন চীন,জাপান, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবে যখন পয়সা প্রচলিত রয়েছে তখন বাংলাদেশে কেন এই ধাতব মুদ্রাকে এতো অবজ্ঞা, অবহেলা। 

বাংলায় সেই খ্রিস্টীয় শতকের বেশ আগে থেকেই মুদ্রার প্রচলন রয়েছে। মহাস্থানগড়ের শিলালিপিতে কাকনিক ও গন্ডক  নামের দুটো মুদ্রার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্যালটিস নামের মুদ্রার কথাও জানা যায় পেরিপ্লাসের গ্রন্থ থেকে। এই মুদ্রাগুলো ছিল স্বর্ণের। 

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, রাজশাহী,যশোর, ঢাকায় প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কুশান যুগ, পাল যুগের মুদ্রাও বাংলায় পাওয়া যায়। এসময়কার বাঙালিরা ব্যবসা বাণিজ্যে নিজেদেরকে নিয়োজিত করায় আমদানি ও রপ্তানি কাজে তারা এই মুদ্রায় ব্যবহার করতো। ফলে সে সময় বাংলার মানুষ মুদ্রার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে । তবে সেন আমলে এই মুদ্রার প্রচলন কিছুটা কমে যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম ৫, ১০, ২৫, ৫০ পয়সার ধাতব মুদ্রার প্রচলন করা হয়। তারপর ১৯৭৪ সালে ১ পয়সা ও ১৯৭৫ সালে ১ টাকার ধাতব মুদ্রার প্রচলন ঘটে। অত:পর ২ টাকার ধাতব মুদ্রার প্রচলন করা হয়। বর্তমানে ৫ টাকার ধাতব মুদ্রার প্রচলন থাকলেও জনগনের কাছে এগুলো যেন অকেজ বা মৃত লাশ। 

দেশের মুদ্রার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ থেকে এর সকল লেনদেনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পয়সা গ্রহন ও লেনদেনে অনিচ্ছা দেখা যায়। সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে যানবাহন চালক এমনকি ভিক্ষুকও এই পয়সা গ্রহন করতে চান নাহ।

কিন্তু কেন কমে যাচ্ছে? 

প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয়ে আসা এই মুদ্রাগুলো ব্যবহারে অনীহার কারণ হিসেবে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় কাগজি নোট। বর্তমানে ২ , ৫ , ১০, ২০,৫০,১০০,২০০, ৫০০,১০০০ টাকার কাগজি নোট থাকাই যেন ধাতব মুদ্রার এই কাল হওয়ার প্রধান কারণ। 

এছাড়া ২০১৫ সালে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেয়া এক বক্তব্য ধাতব মুদ্রার লেনদেনে জনমনে আশঙ্কা তৈরি করে দিতে পারে। উনি তার বক্তব্যে বলেন, ১ টাকা ও ২ টাকার কোনো পয়সা আর চালু থাকবে না। ৫ টাকার পয়সা দিয়ে লেনলেন করা হবে। যদিও তিনি তার বক্তব্যের সুর পরে পরিবর্তন করেন। তারা তখন থেকেই এই মুদ্রা অকেজো হয়ে যাওয়ায় আতঙ্কে লেনদেন থেকে বিরত হতে শুরু করেন। 

বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলোর ধাতব মুদ্রা গহনের অনীহাও এই ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। কাগজি মুদ্রা অপেক্ষা ধাতব মুদ্রা গণনায় সময় বেশি প্রয়োজন হয়। ফলে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলো অনেক সময় এই মুদ্রা গ্রহন করতে চায় না। এর ফলে ঘটে বিপত্তি। জনগণ এই মুদ্রা তাই লেনদেনই করতে চায় না।  

কিছু অসাধু ব্যক্তি তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক ছড়ায় যে ধাতব মুদ্রাগুলো আর চলবে না। এরই ফলস্বরুপ তারা ক্যান্ডি প্রথার প্রচলন ঘটায়। ব্যবসায়ীরা এক, দুই ও তিন টাকা ভোক্তাদেরকে ফিরত না ফিয়ে ক্যান্ডি হাতে ধরিয়ে দিতে শুরু করে। এভাবে হাতিয়ে নেয় কোটি-কোটি টাকা। ভোক্তারাও এটি নিয়ে মাথা ব্যথা দেখায় না, ফলে এটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার বার নানা সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপণ, প্রচারণা এমনকি বিধিনিষেধের পরও এই মুদ্রার ব্যবহারে অনীহা দূর করা যাচ্ছে না।

অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে এই ধাতব মুদ্রা কতটুকু গুরুত্ব বহন করে? 

বাংলাদেশ সরকার যদি ধাতব মুদ্রার প্রচলন আবারো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এমনটা ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ ধাতব মুদ্রার তুলনায় কাগজি মুদ্রা তৈরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০০ গুন বেশি খরচ হয়। 

প্রথমেই প্রয়োজন হবে জনগনের মধ্যে বিশ্বাস ফরিয়ে আনা যে বাংলাদেশে ধাতব মুদ্রা অচল নয়। তাদের মধ্যে সচেতনতায় পারে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ফিরিতে আনতে। 

নাওশিন মুশতারী,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। 

[email protected]

 

Share this news