৬৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ের পর চারটি অপরিকল্পিত প্রকল্প বাতিল করলো সরকার
তিনটি প্রকল্প শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করা তিনটিসহ কম অগ্রাধিকারের চারটি প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর জন্য ইতোমধ্যে ৬৭৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতাভুক্ত প্রকল্প হলো নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরের শেখ জহুরুল হক পল্লী উন্নয়ন একাডেমি এবং খুলনার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার।
অন্যটি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের জন্য ছয়টি ওপেন-হেডেড ট্যুরিস্ট বাস ক্রয় সংক্রান্ত প্রকল্প।
সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, "এই প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং সরকার সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। আবার, কিছু চলমান প্রকল্পও স্থগিত করা হচ্ছে।"
তার মতে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়ন সংস্থাগুলো এমন অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করার চেষ্টা করছে।
এই প্রকল্পগুলোর জন্য প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে আসে। প্রকল্পগুলো মাঝপথে বাতিল করায় ২,৭৪৪ কোটি টাকা তাৎক্ষণিক সাশ্রয় হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এসব প্রকল্প মাঝপথে বাতিল করায় সম্ভাব্য সুবিধাভোগীরা তাদের প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
তারা বলছেন, ইতোমধ্যে ব্যয় করা বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অপচয় হতে পারে এবং অসম্পূর্ণ ভবন ও উপকরণ যদি অযত্নে ফেলে রাখা হয়, তাহলে তা নষ্ট হতে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, "এই প্রকল্পগুলো বাতিল করা হচ্ছে কারণ এগুলো জনগণের প্রকৃত চাহিদা ও সরকারের বাস্তবায়ন সক্ষমতা যাচাই না করেই নেওয়া হয়েছিল।"
তিনি আরও বলেন, অনেক প্রকল্পে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে প্রকল্প অনুমোদন ও তহবিল প্রাপ্তি সহজ করা হয়েছিল, যা জনগণের সম্পদের সদ্ব্যবহারের সুযোগকে নষ্ট করেছে।
ড. মুজেরী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করার এবং এগুলো শুরু করার সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
কর্মকর্তারা জানান, যশোরে একাডেমি প্রকল্প মাঝপথে বন্ধ করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে।
২০২২ সালে শুরু হওয়া ১৯৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ পর্যন্ত ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
যশোরের মণিরামপুরে অবস্থিত এই একাডেমি প্রকল্পটি শেখ হাসিনার নানা শেখ জহুরুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কমিটির বৈঠকের সভাপতি এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া বলেন, প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা, সম্ভাব্য ফলাফল এবং বিনিয়োগকৃত অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা হলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত।
তিনি প্রকল্পের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে যথাযথ সমীক্ষা পরিচালনার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ বাস্তবায়িত পূর্ববর্তী প্রকল্পগুলো, বিশেষ করে উন্নয়ন একাডেমি, প্রশিক্ষণ একাডেমি বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রকল্পগুলো, পর্যালোচনা করা উচিত।
কুমিল্লার বার্ড এবং বগুড়ার আরডিএর দীর্ঘকালীন কার্যক্রম সুপরিচিত হলেও গোপালগঞ্জ, জামালপুর ও রংপুরে নতুন প্রতিষ্ঠিত একাডেমিগুলোর অবদান তুলনামূলকভাবে কম দৃশ্যমান।
গোপালগঞ্জ প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স যশোর থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় যশোর অঞ্চলে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম গোপালগঞ্জ থেকে পরিচালনা করার পরামর্শ দেন তিনি। এর ফলে, অতিরিক্ত অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দূর হবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পর্যটক কোচ কেনার প্রকল্প বাতিল করেন, যেখানে ৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা অপচয় হয়েছে।
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ২৭ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি ২০২০ সালে গৃহীত হয়েছিল।
কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের জন্য একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো পক্ষ প্রস্তাব জমা দেয়নি। ফলে আগের সরকার নিজেই প্রকল্পটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
‘শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা’ প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৭ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব উপেক্ষা করে এর মেয়াদ চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এ প্রকল্পের জন্য প্রথম সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৪৬ কোটি টাকা, যা মূল প্রকল্প ব্যয়ের মাত্র ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ (২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা)।
প্রকল্পটি ৫২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২টি আবাসিক ভবন, ৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭টি অনাবাসিক ভবন এবং আরও কিছু অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল।
তবে সংশোধিত প্রকল্পে কোনো একাডেমিক বা প্রশাসনিক ভবন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
২০১৭ সাল থেকে শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের প্রাঙ্গণে চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেন, বর্তমান প্রকল্পের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে জানুয়ারির মধ্যে কার্যক্রম নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা কঠিন হবে।