প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
১৯৩৯ সাল। গোটা ভারতবর্ষে চলছে ব্রিটিশ শাসন। তখন ঢাকা ও কলকাতার মতো শহরগুলোতে বড় বড় অফিস গড়ে উঠছিল। সে সময়ে পুরান ঢাকার রায়েরবাজার, বংশাল রোড, কোর্ট-কাচারি ও আশেপাশের এলাকায় দাপ্তরিক ও ব্যবসায়িক কাজের জন্য মানুষের চলাচল বাড়তে থাকে। তাই ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদ ইউসুফ ছোট পরিসরে কেক-বিস্কুটের ব্যবসা শুরু করেন। যা সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠেছে ঢাকাবাসীর প্রিয় ইউসুফ কনফেকশনারী।
নানা আবদুল ব্যাপারীর কেক-বিস্কুটের ব্যবসা ছিল। সেখান থেকেই ইউসুফের বেকারি ব্যবসার হাতেখড়ি। শুরুটা ছোট পরিসরে হলেও ব্যবসায় পারদর্শী ইউসুফ অল্প সময়ের মধ্যে নিজের নামে বেকারির দোকান খুলেন। সেই থেকে তিন পুরুষ ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে এর যাত্রা। যাত্রার প্রথম দিকে ইউসুফ কনফেকশনারীর নাম ছিল ইউসুফ বেকারি। এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজারের ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের পাশে।
এরপর ১৯৫৮ সালে জায়গা পরিবর্তন করে ১৯/এ জনসন রোডে দোকান দেওয়া হয়। বেকারি আইটেম ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করায় পরে এর নাম পাল্টে ইউসুফ কনফেকশনারী রাখা হয়। জনসন রোডে দুটি দোকান ছাড়াও বর্তমানে ধানমন্ডি, বাংলামটর, গুলশান, রমনা, মিরপুর, রামপুরাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এর ১০টির বেশি শাখা রয়েছে। ঢাকার বাইরে এর কোনো শাখা নেই।
বর্তমানে ইউসুফ সাহেব বেঁচে না থাকলেও ইউসুফ কনফেকশনারী যুগ যুগ ধরে তার জনপ্রিয়তা ঠিকই ধরে রেখেছে। তার মৃত্যুর পর তার ১১ জন সন্তান ব্যবসার হাল ধরে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শাখা তৈরির মাধ্যমে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকে। কিন্তু ভাইদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরলে সবাই নিজেদের মতো ব্যবসার দায়িত্ব ভাগ করে নেন।
বর্তমানে সন্তানেরা নিজেদের মতো আলাদা আলাদা শাখা পরিচালনা করছেন। তবে ব্যবসা বা দোকান ভাগাভাগি করে আলাদা করে ফেললেও এর সব শাখার খাবার এখনও একই ফ্যাক্টরিতে বানানো হয়। জজকোর্টের পেছনের বেকারি ফ্যাক্টরিতে সকল খাবার বানানোর পর তা সব শাখায় সরবরাহ করা হয়।
যেহেতু একই ফ্যাক্টরিতে সব খাবার তৈরি করা হয় তাই ইউসুফ কনফেকশনারীর সব শাখায় একই মানের খাবার পাওয়া যায়। মালিকরা কেউই তাদের দোকানের জন্য ভিন্ন খাবার চাইলেই বানাতে পারবে না।
এ বিষয়ে ইউসুফ কনফেকশনারীর সবচেয়ে পুরনো শাখার বর্তমান স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইউসুফের সন্তান মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, “আমরা আমাদের খাবারের মান ও স্বাদ এক রাখার জন্যে সব শাখায় একই ধরনের খাবার বিক্রি করি। জনসন রোডের এই শাখায় যে খাবার পাওয়া যায় এই একই খাবার ধানমন্ডি, বাংলা মটর ও অন্য শাখাগুলোতেও পাওয়া যাবে।”
কিন্তু একই জায়গায় সব খাবার বানানো হলেও সেখানে আগের মতো চানাচুর উৎপাদন করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চানাচুরের ব্যবসা ছয় বছর আগে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে ‘খান চানাচুর’ নামে আরেকটি ফ্যাক্টরিতে চানাচুর উৎপাদন করা হয়। উৎপাদনের পর দোকানগুলোতে সরবরাহ করা হয়।
শুধু কেক ও বিস্কুট নয়, বিভিন্ন ধরনের পরোটা, রুটি, পাউরুটিসহ স্ন্যাকস আইটেমের মহাসমারোহের দেখা মিলবে এখানে। সুলভ মূল্যের মধ্যে হরেক স্বাদের বিস্কুটের দেখা পাওয়া যাবে ইউসুফ কনফেকশনারীতে। সল্টেড বিস্কুট, চকলেট বিস্কুট, টোস্ট বিস্কুট, ওভালটিন বিস্কুট, ডিনার স্টিক, ড্রাই কেক বিস্কুটসহ অনেক ধরনের বিস্কুট এখানে পাওয়া যায়।
হরেক রকমের বিস্কুট
ইউসুফ কনফেকশনারীর প্যাটিসের পাশাপাশি বাটার বান, ক্রিম রোল, বার্গার, স্যান্ডউইচের মতো বিভিন্ন স্ন্যাকস আইটেম বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে কাপকেকের মতো দেখতে প্যাটিসের বেশ নাম-ডাক রয়েছে। কাপ প্যাটিস ছাড়াও রয়েছে মাটন প্যাটিস, রোল প্যাটিস ও চিকেন প্যাটিস।
স্ন্যাকস আইটেম ও পরোটা
এখানকার স্ন্যাকস আইটেমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিক্রিত আইটেম হলো চিকেন প্যাটিস। এছাড়াও তারা নিজেদের তৈরি আলুর চিপসও বিক্রি করে থাকে। চিজ ফিংগার নামে বাইরে দিয়ে পেচানো ও ভেতরে চিজে ভরপুর একটি আইটেম রয়েছে যা অনেকেরই বেশ পছন্দের। মুকরুম নামে এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। যেটা খেতে গেলেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যায়।
পরোটা ও রুটির জন্যেও ইউসুফ কনফেকশনারী অনেকেরই প্রথম পছন্দ। এখানে পরোটার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হলো টানা পরোটা ও চিকেন পরোটা। সকালের নাস্তা সেরে নেওয়ার ক্ষেত্রেও আদর্শ জায়গা হতে পারে এটি। শবে বরাতের সময়ে ফ্যান্সি রুটি বা স্পেশাল বাগদাদী ব্রেড নামে বিশাল আকারের রুটি তৈরি করা হয়। বিশাল আকার বানানোর পাশাপাশি এই রুটিতে বাহারি নকশা করা হয়ে থাকে। বড় বড় মাছের আকৃতি কিংবা ফুল বা পাতার নকশা করা হয় ফ্যান্সি রুটিতে। সেই সাথে নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজড ফ্যান্সি রুটিও বানিয়ে নেওয়া যাবে।
মাছের আকৃতির ফ্যান্সি রুটি
সাধারণত একটি ফ্যান্সি রুটির ওজন ২-৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বলতে গেলে পরিবারের সকলের জন্য এই বিশাল আকৃতির একটি রুটিই যথেষ্ট। শবে বরাতে ফ্যান্সি রুটি তৈরির পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে রুটি ও বিভিন্ন ধরনের হালুয়া তৈরি করে আসছে তারা। বুটের হালুয়া, সুজির হালুয়া, গাজরের হালুয়া, নেশেস্তার হালুয়াসহ হরেক রকমের হালুয়া পাওয়া যায় তখন। রোজায় পুরো মাস জুড়ে এখানে নানা রকমের ইফতার আইটেম পাওয়া যায়। তখন বেকারি খাবারগুলোর পাশাপাশি নান রুটি, গ্রিল, হালিম, জিলাপি, কাটলেট, জালি কাবাব ও সুতা কাবাব পাওয়া যায়।
ইউসুফ কনফেকশনারীর সবার পছন্দের আইটেম হলো তাদের কেক। কেকের মধ্যে রয়েছে প্লেইন কেক, ওভালটিন ফ্রুটস কেক, চেরি কেক, জ্যামরোল। এখানে জন্মদিনের জন্যেও কেক তৈরি করা হয়ে থাকে। প্লেইন কেক এখানকার সবচেয়ে বেশি বিক্রিত আইটেম।
এখানে চানাচুর ভিন্নভাবে তৈরি করা হয়। বেশিরভাগ চানাচুরই প্যাকেটজাত হয়ে থাকে। সেই চানাচুরে উপকরণগুলো আগে থেকেই মেশানো থাকে। তবে ইউসুফ কনফেকশনারীর চানাচুরের সবগুলো উপকরণ আলাদা আলাদা বৈয়ামে ভরে রাখা হয়। বাদাম, চানার ডাল, মুগ ডাল, চিড়া এগুলো সব ভেজে আলাদা করে রাখা হয়। ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী উপকরণগুলো মিশিয়ে তারপরে চানাচুর প্রস্তুত করা হয়। চানাচুরের উপকরণগুলো আলাদাভাবেও কেনা যায়।
আলাদা আলাদা বৈয়ামে রাখা চানাচুরের উপকরণ
ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির সাথে খাবারের মূল্যের ভারসাম্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ইলিয়াস বলেন, “খাবারের দাম তেমন বাড়াতে পারি নাই। প্রতি বছরে অল্প করে বাড়ানো হয়। তাছাড়া প্রতি বার সব খাবারেরও তো দাম বাড়ানো যায় না। ক্রেতাদের ব্যাপারটা মাথায় রেখে সেই অনুযায়ী মূল্য বাড়ানো হয়।”
করোনার সময়ে ইউসুফ কনফেকশনারী দুই মাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল। ইলিয়াস জানান, “করোনা মহামারির সময়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের বেশ কষ্ট হয়েছে। করোনার আগে ব্যবসা ভালো চলত। অনেক জায়গা থেকে অনেক বড় বড় অর্ডার আসতো। কিন্তু করোনার সময়ে আমাদের আরেকটা ফ্যাক্টরি ছিল সেটা বন্ধ হয়ে যায়। সে সময়ে যে ক্ষতি হয়েছে সেটি পুষিয়ে নিতে এখনও সমস্যা হচ্ছে। আবার করোনার পরে আমাদের ক্ষতির কারণে অল্প কিছু আইটেম বাদ দিতে হয়েছে।”
লম্বা সময় ধরে ইউসুফ কনফেকশনারী ক্রেতাদের কাছে আস্থার জায়গা হয়ে আছে। এমন বহু ক্রেতা আছে যারা এই স্থান ছাড়া আর অন্য কোনো দোকানের বেকারি আইটেম কিনতেই চান না। এমনই একজন ক্রেতা হলেন ড. হুমায়রা।
তিনি বলেন, “ইউসুফ কনফেকশনারীর প্রতি আমার আস্থা থেকেই আমি মাঝে মাঝেই ওদের দোকানগুলোতে যাই। যেকোনো সময়ে হালকা ক্ষুধা মেটানোর জন্যে ওদের কেক বা বিস্কুট আমার কাছে সবসময়ই আদর্শ খাবার। আমার কাছে বেকারি আইটেমের ব্র্যান্ড মানেই ইউসুফ। এটি বলতে গেলে ঢাকার ঐতিহ্যের একটি অংশ।”
৮৪ বছর ধরে এভাবেই ইউসুফ কনফেকশনারী তাদের মুখরোচক খাবার দিয়ে ঢাকাবাসীর মনে জায়গা করে নিয়েছে।