Bangla
a day ago

কেউ 'পাগল' হলে কেন তাকে 'চন্দ্রগ্রস্থ' বা 'লুনাটিক' বলা হয়?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি Photo : ক্রিস্টিন মিলস

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

রাতের আকাশে যখন সবার দৃষ্টি আটকে যায় একটি রুপালি গোলার দিকে, তখন সেই আলো শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের কল্পনাকেও গভীরভাবে নাড়া দেয়। চাঁদ যতটা কাছে মনে হয়, ঠিক ততটাই রহস্যময়। মানুষ হাজার বছর ধরে লক্ষ্য করে আসছে, চাঁদের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মেজাজ, আবেগ আর আচরণেও যেন এক অদৃশ্য প্রভাব কাজ করে। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই জন্ম হয়েছে একটি ধারণা, কেউ 'পাগল' হলে সে 'চন্দ্রগ্রস্থ', আর ইংরেজিতে তাকে বলা হয় লুনাটিক। এই শব্দের শিকড় লুকিয়ে আছে রোমান পুরাণের চন্দ্রদেবী লুনা-র গল্পে।

প্রাচীন মানুষরা বিশ্বাস করতো, চাঁদের আলোতে মানুষের মন নরম হয়, আবেগ বাড়ে এবং কখনও কখনও আচরণও হয়ে ওঠে অযৌক্তিক। রাতের অতিরিক্ত আলো ঘুম কমিয়ে দেয়, শরীরে এক ধরনের স্নায়বিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে, আর ঘুম-হরমোন মেলাটোনিন কমে গেলে মন হয় চঞ্চল ও অস্থির।

এই শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনকে সহজেই তারা যুক্ত করেছিল অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে। তাদের বিশ্বাস, চাঁদের আলো মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে ঢেউ তুলে দেয়, যেমনটা সে করে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার ক্ষেত্রে। তাই কারও আচরণ হঠাৎ পরিবর্তন হলে তার ব্যাখ্যা দাঁড়াত 'চাঁদে ধরেছে' বা সে চন্দ্রগ্রস্থ।

এই ধারণা শুধু বিশ্বাসের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল না। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ণিমা ও মানসিক অস্বাভাবিকতার মাঝে সম্পর্ক খোঁজা হয়েছে।

হাসপাতালে ভর্তি মানসিক রোগীর সংখ্যা, রাতে সংঘর্ষ বা ঝগড়ার ঘটনা, এমনকি অপরাধ অনেক সমাজেই বলা হতো, এগুলো পূর্ণিমায় বেড়ে যায়। যদিও আধুনিক গবেষণা, এই সম্পর্ক পুরোপুরি প্রমাণ করতে পারেনি, তবুও চাঁদের প্রতি সেই প্রাচীন সন্দেহ আজও টিকে আছে। কারণ, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা শেষ হলে শুরু হয় মিথের আকর্ষণ।

আর সেই মিথের কেন্দ্রে রয়েছেন লুনা, রোমানদের চাঁদের দেবী। তার গল্প শুধু রহস্য নয়, গভীর প্রেম আর অনন্ত আকুলতার প্রতীক। লুনা প্রতিদিন রুপালি রথে চড়ে আকাশে ভেসে বেড়ান। তার হাতে থাকে চন্দ্রালোকে ভরা টর্চ, যার আলো পৃথিবীতে জমিয়ে রাখে নীরবতা, স্বপ্ন আর কখনও কখনও উন্মাদ আবেগ। এই দেবীর উপস্থিতি মানুষের জীবন ছুঁয়ে যায় রাতের অদৃশ্য স্পর্শে।

লুনার প্রেমে পড়েছিলেন এক মানব এন্ডিমিয়ন। এক অদ্ভুত, সুন্দর যুবক। তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং লুনা।

রাত ছিল এন্ডিমিয়নের প্রিয় সময় তাই পাহাড়ি ঢালে ঘাসের উপর শুয়ে তিনি তারা দেখতেন, বাতাসের শব্দ শুনতেন। আর সেখানেই লুনার নজরে পড়েন তিনি। আকাশের দেবী নেমে আসেন তার কাছে। প্রতিরাত তিনি ঘুমিয়ে পড়ার পর লুনা আলতো করে চুমু দিতেন তার চোখের পাপড়িতে। সেই আলোতেই ছড়িয়ে যেত দেবীর প্রেম।

কিন্তু লুনার সামনে ছিল সবচেয়ে বড় দোটানা. মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর দেবীরা প্রেম চায় অনন্তকাল। তিনি চাননি এন্ডিমিয়ন বুড়িয়ে যাক, প্রেম হয়ে উঠুক সময়ের কাছে পরাজিত।

তাই লুনা দেবতাদের রাজা জিউসের কাছে প্রার্থনা করলেন, এন্ডিমিয়ন যেন চিরযৌবন আর চিরন্তন নিদ্রা লাভ করে। ফলে এন্ডিমিয়ন ঘুমিয়ে রইলেন চিরকাল; না বৃদ্ধ হলেন, না জাগলেন। তার নিদ্রিত দেহকে প্রতিরাতে ঢেকে রাখে লুনার মায়াঘেরা আবেশী আলো; দুই জগতের মাঝামাঝি জুড়ে ব্যাপ্ত থাকা এক চিরন্তন প্রেমের প্রতীক হয়ে।

এই প্রেম অন্যরকম সুন্দর; যেখানে জাগরণ মানে বিচ্ছেদ, আর ঘুম মানে চিরন্তন মিলন। তবে, লুনাকে দেখতে পাওয়ার অধিকার ছিল না আর কোনও মানুষের। তাই কেউ যদি লুনাকে ভ্রমণরত অবস্থায় দেখে ফেলতো, লোকজ বিশ্বাস অনুযায়ী তার রূপ সহ্য করতে না পেরে ভয়ে পাগল হয়ে যেত।

এই কারণেই চাঁদকে শুধু আকাশের বস্তু নয়, মন ও স্বপ্নের দেবী হিসেবে দেখা হয়। লুনার প্রেম মানুষের বিশ্বাসে যোগ করে দিয়েছে এক নতুন আবেগ, চাঁদের আলোতে মানুষ কখনও স্বাভাবিক থাকে না; প্রেমও পাগলামির মতো এসে ভর করে। তাই অনেকেই মনে করতো চাঁদের স্পর্শে মানুষ যুক্তিবোধ হারায়, আর আচরণ হয় লুনাটিক। এ থেকে জন্ম নেয় ভাষার সবচেয়ে নাটকীয় এক শব্দ; 'লুনাটিক' লুনা বা চাঁদ-প্রভাবিত ব্যক্তি চন্দ্রগ্রস্থ।

রোমান যুগে মানসিক অসুস্থতাকে সরাসরি বলা হতো 'চাঁদের রোগ'। আদালতের নথিপত্রেও লেখা থাকত সে পূর্ণিমায় অপরাধ করেছে, অর্থাৎ তখন সে নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, চাঁদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

বাংলার গ্রামেও আজো অমাবস্যা ও পূর্ণিমাকে ঘিরে আছে নানান লোকবিশ্বাস। পূর্ণিমার রাতে নাকি ভূত বেশি বের হয়, শিশুরা বেশি কান্নাকাটি করে, মানুষ হয় বেশি অস্থির।

চাঁদকে দোষ দেয়া হয় প্রেম, পাগলামি, রাতের ভৌতিক কানাঘুষো; সবকিছুর জন্য। কারণ, চাঁদের প্রতি মানুষের মুগ্ধতা কখনোই সাধারণ ছিল না। এই কারণেই চাঁদ এক দ্বিমুখী প্রতীক; একদিকে প্রেম, আলো, কবিতার অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে ভয়, অজানার আহ্বান ও মানসিক অস্থিরতার চিহ্ন।

mahmudnewaz939@gmail.com

শেয়ার করুন