প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত এক যুবক, সাথে ষাট হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। আরো আছে উন্নত রেশমি সাজে সজ্জিত শত শত উট ও দাসদাসী। তাদের গন্তব্য আরবের পবিত্র মক্কা নগরী। উটগুলো স্বর্ণ ও মনিমুক্তা দিয়ে বোঝাই। যাত্রাপথে যাকেই পাওয়া যাচ্ছে তাকেই দান করা হচ্ছে তা থেকে। তবুও উটের পিঠ থেকে সম্পদের ভার যেন কমছে না।
ফোর্বসের ধনীর তালিকায় ঘুরে ফিরে যাদের নাম উঠে তাদের মাঝে ইলন মাস্ক ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৩২০ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছিলেন, যা এখনো পর্যন্ত ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
তবে আধুনিক ইতিহাস একপাশে রেখে মধ্যযুগে এমন এক ব্যক্তির খোঁজ মেলে যার সম্পদের মূল্য বর্তমানের হিসেবে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন বা চল্লিশ হাজার কোটি ডলার! সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, তিনি ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। যেই আফ্রিকাকে ভাবা হতো অসভ্যদের দুনিয়া বা অন্ধকার মহাদেশ সেই আফ্রিকাতেই জন্মেছিলেন তর্কসাপেক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি মানসা মুসা।
কে ছিলেন মানসা মুসা?
মানসা মুসা ছিলেন চৌদ্দশ শতকের মালি সাম্রাজ্যের শাসক। মালিতে শাসকের খেতাব হলো ‘মানসা’। মুসা ছিলেন মালির দশম মানসা। ১৩১২ সাল থেকে ১৩৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তার পূর্বে মালির মানসা ছিলেন দ্বিতীয় আবু বকর, যিনি তার নৌ-বহর নিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সমুদ্রে (আমেরিকার দিকে) আভিযানে বেড়িয়েছিলেন। তিনি আর কোনোদিন ফিরে আসেননি।
তখন মালি ছিল আফ্রিকার সমৃদ্ধতম অঞ্চল। বর্তমানে মালি বলতে আমরা আফ্রিকার যে দরিদ্র দেশটিকে বুঝি তখনকার মালি ছিল তা থেকে ভিন্ন। পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, নাইজার, নাইজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, চাদ ইত্যাদি দেশগুলো বৃহৎ মালি সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল। এটি ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্য। মানসা মুসা ছিলেন সেই সাম্রাজ্যের সুলতান।
সম্পদের উৎস
মানসা মুসা ক্ষমতা লাভের পূর্বেও মালি বেশ সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। মালির সম্পদের মূল উৎস ছিল এর মূল্যবান স্বর্ণের খনি। মালির খনি থেকে প্রচুর স্বর্ণ উত্তোলন করা হতো। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে স্বর্ণের ব্যাপক চাহিদা ছিল। পাশাপাশি লবণের খনি থেকেও মালির অনেক আয় হতো। স্বর্ণ ও লবণ এই দুটিই ছিল মালির সম্পদের মূল উৎস।
মানসা মুসা ক্ষমতায় এসে মালির অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করতে চাইলেন। তিনি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার সময় মালির স্বর্ণ ও লবণের জন্য নতুন বাজার তৈরি হয়েছিল। তিনি মালির অর্থনীতিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যা তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
বিখ্যাত হজ্জ যাত্রা
১৩২৪ সালে মানসা মুসা মক্কায় হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হলেন। মক্কা নগরী ছিল মালি থেকে (৬৫০০ কিলোমিটার) কয়েক মাস দূরের পথ। কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, তার সাথে ছিল ষাট হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। আরো ছিল বারো হাজার দাসদাসী ও স্বর্ণ দিয়ে বোঝাই শতাধিক উট। মক্কা যাওয়ার পথে রয়েছে বিশাল সাহারা মরুভূমি। এরপরই মিশর। যাত্রা পথে যারা তার দেখা পেয়েছিল তারা ছিল সৌভাগ্যবান। সবাইকে স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেয়া হয়েছিল হিসাব ছাড়া।
মিশরের কায়রোতে পৌঁছে তিনি আরেকদফা দান করলেন। তার চলে যাওয়ার পর বারো বছর পর্যন্ত মিশরের বাজারে স্বর্ণের দাম পরে গিয়েছিল। বিখ্যাত এই হজ্জ যাত্রা দিয়েই মানসা মুসা আরব বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আরবে তাকে নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত হতে লাগলো। সেখান থেকেই মানসা মুসার জনপ্রিয়তা শুরু।
মালির টিম্বাকটু
সাহারা মরুভূমি পার হয়ে আফ্রিকার পশ্চিমে অবস্থিত শহর মালির টিম্বাকটু। ১৩০০ থেকে ১৬০০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল এটি। মানসা মুসার শাসনামলে এই শহরটি চূড়ান্ত উন্নতি দেখেছিল। টিম্বাকটুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, মসজিদ ও বিদ্যালয়গুলো তারই কীর্তি।
মালির বিখ্যাত সানকোর বিশ্ববিদ্যালয় চৌদ্দশ শতকে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। বিশ্বখ্যাত ইসলামী পন্ডিতরা এখানে আসতেন জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে। আফ্রিকায় ইসলাম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বিদ্যালয়টি।
১৩৩৭ সালে মানসা মুসা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ১৫ শতক পর্যন্ত মালি সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন ছিল। ১৪৬০ সালে মালিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পার্শ্ববর্তী মরক্কো ও সাঙ্ঘাই সাম্রাজ্যের প্রভাবে মালি তার জৌলুশ হারাতে থাকে। সবশেষে, ১৭ শতকে ইউরোপীয়দের আগমনে মালি সাম্রাজ্যের সমাধি নিশ্চিত হয়।
সাজিদ আল মাহমুদ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়ন করছেন।
shajidmahmud11@gmail.com