প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
আমার ভালোবাসা তোমার চেয়ে বড়। আমি তোমাকে সমস্ত পৃথিবীর চেয়ে বেশি ভালোবাসি। তারপর? প্রেমই ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় রহস্য। আচ্ছা, ঈশ্বর আসলে কে? ঈশ্বর আমাদের ভেতরেই আছে। আমাদের শুধু তাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রশ্ন। উত্তর। চলছে। কিন্তু, মনীষা, অনিমেষের কথা শুনে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। অনিমেষ বারবার জিজ্ঞেস করছে, তুমি এতো হাসছো কেন? আমি কি কিছু ভুল বলেছি? ওমনি মনীষা, অনিমেষকে একটি বই দিয়ে নরমসরম আঘাত করলো। বইটি চোখে পড়তেই অনিমেষ বলতে শুরু করলো, না, মানে, আজকেই পড়লাম তো।
যে কথাগুলো অনিমেষ তার বলে দাবি করলো, ওগুলো আসলে আহমেদ ছফার বিখ্যাত উপন্যাস ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ থেকে নেওয়া। এরকম বহু ঘটনাই হরহামেশা ঘটে, যেখানে পছন্দের উপন্যাসের প্রিয় লাইনগুলো প্রেমের দরবারে ‘আমার আমার’ বলে পরিবেশিত হয়। যাই হোক। দেশীয় লেখকদের খোঁজখবর যারা রাখেন, ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছেন; ৩০ জুন ছিল, আহমেদ ছফার জন্মদিন। তাই তাকে ঘিরেই আজকের লেখা।
লেখক ছফার প্রকাশিত অপ্রকাশিত সৃষ্টি হিসাব করলে, পঞ্চাশ বা তারচেয়ে বেশি কাজের খবর পাওয়া যায়। এরমধ্যে অত্যধিক জনপ্রিয়, গাভী বৃত্তান্ত (১৯৯৫), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), ওঙ্কার(১৯৭৫), যদ্যপি আমার গুরু(১৯৯৮), প্রভৃতি।
একজন লেখকের সার্থকতা নিয়ে কথা বললে, বিস্তর শব্দ খরচ করেও হয়তো তার কূলকিনারা করা সম্ভব হয় না। তবু, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে, লেখক তো সমাজ ও মানুষের জন্যই লেখেন। যার লেখায় সমাজ, মানুষের ভালো-মন্দ দিক থাকে, তার সৃষ্টিকে নিঃসন্দেহে ভালো বলতে হয়।
যদিও, কথা থাকে, লেখকের ভালো-মন্দ নিরুপণের গুরুদায়িত্ব কারো নেয়ার দরকার পড়ে না। তার কর্ম, নিজ উদ্যোগেই সেগুলো প্রকাশ করে। দায়িত্ব থেকে নয়, প্রেম থেকেই যদি আহমেদ ছফার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি হয়, মন্দ হবে না নিশ্চয়ই।
গাভী বৃত্তান্তে, ছফা লিখেছেন, এই দেশে মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু মানবতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সহজসরল এই কথার তাৎপর্য বা প্রাসঙ্গিকত বুঝতে বোধ করি ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। চোখের সামনে পড়ে থাকে আহত রক্তাক্ত দেহ, আর ওখানেই যখন সহযোগিতার বদলে মোবাইলের ফ্লাশলাইট জ্বলে ওঠে, তখন ছফাকে স্মরণ না করি কী করে?
একই পুস্তকে লেখক বলেছেন, যত ক্ষমতা ততো অপকর্ম। লাইনটি চোখে পড়তেই আশা করি, চোখে দৃশ্যমান হচ্ছে বহু মানুষের মুখ। ঠিক এভাবেই আহমেদ ছফা, ছোটো বাক্যে বড় বড় বাস্তবতাকে বন্দী করেছেন। আবার ছোটো গল্পে তিনি বলেছেন, একটা মানুষের সাহস, দশটা অবিচারের চেয়েও শক্তিশালী। এরকম বহু কথায় চোখ রাখলে এবং হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে, বুঝতে বাকি থাকে না, আহমেদ ছফা কীভাবে এখনো প্রাসঙ্গিক।
একজন লেখক কি শুধু লেখেন? সেটা যদিও ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তবু, যারা সমাজ ও মানুষ নিয়ে সচেতন, কিংবা যারা শুধু লেখায় সীমাবদ্ধ থাকতে চান না, তারা লেখার বাইরে গিয়েও অনেক দায়িত্ববোধের পরিচয় দেন। আহমেদ ছফা সেরকমই একজন।
বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন তার সম্পাদনায় একটি পত্রিকা (প্রতিরোধ) প্রকাশিত হয় এবং এটিই বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা। জানা যায়, পত্রিকা থেকে পাওয়া অর্থের লভ্যাংশ, দশ হাজার টাকা তিনি যুদ্ধে খরচের জন্য তহবিলে জমা দিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে ছফা বলেছিলেন, “ শেখ সাহেবের রেসকোর্স মিটিং-এ বিক্রির জন্য আমরা কয়েকজন পত্রিকাটি বার করেছিলাম। পত্রিকার একটি কপি আহমদ শরীফের হাতে দিয়েছিলাম। পাওয়ামাত্র চোখ বুলিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে ড. শরীফ বলেছিলেন, ‘আমি এখন পাকিস্থানে না, স্বাধীন বাংলাদেশে আছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েগেছে। তুমি, তুমিই স্বাধীনতার বরপুত্র, নায়কের জন্মদাতা, ‘প্রতিরোধ’ তার মাধ্যম’।
ঢাকার বস্তিগুলোতে বাচ্চাদের অর্থ ছাড়া পড়াশোনার জন্য স্কুল খোলা, বক্তব্যে সমাজব্যবস্থার ফাঁকফোকর নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, সমসাময়িক লেখকদের প্রেরণা দিতে; ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ নামে প্রতিষ্ঠান করা। শুধু প্রতিষ্ঠান করা নয়, সরাসরি তিনি বহু লেখকের প্রশংসা করেছেন। যেমন, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, ফরহাদ মজহার, তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খান, ইত্যাদি। বলতে দ্বিধা নেই, লেখায় যেমন বুক উজাড় করে দিয়েছেন, তেমনি অন্যান্য দায়িত্ব পালনেও ছফা অনন্য ছিলেন।
যদি ছফা বেঁচে থাকতেন, তবে জন্মদিনে নিশ্চয়ই তিনি শুধু ‘শুভ জন্মদিন’ বা মোমবাতির আলোয় ফুঁ দেয়া উপভোগ করতেন না। তিনি চাইতেন, এমন কোনো মোমবাতি, যা দরকারে জ্বলে উঠবেই। হাজারো ফুঁয়ে যা কোনোদিন নেভে না। নিভে যায় না।
sanjoydatta0001@gmail.com