Bangla
2 years ago

আলাউদ্দিন আলী: সুরের গুরু দাও গো সুরের দীক্ষা

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

"কেন আশা বেঁধে রাখি? জানি আসবে না ফিরে আর তুমি, তবু পথ পানে চেয়ে থাকি।" আশা বেঁধে রাখি, কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুরতায় যারা একবার পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তারা কি আর ফিরে আসে?

সংস্কৃতির পরম্পরা যুগে যুগে বদলায়। এক প্রজন্ম যে নাম শোনেনি, চোখে দেখেনি, পূর্ব-প্রজন্মের কাছে তা স্মৃতিতে অমলিন, এক নস্টালজিয়া। কিন্তু সময় আমাদেরকে এমন কিছু মানুষের সাথে পরিচয় করায়, যাদের দাপট রয়ে যায় যুগ থেকে যুগান্তরে।

বরেণ্য সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী এমনই একজন। আমাদের বাবা-মায়ের প্রিয় গানগুলোর সার্থক স্রষ্টা তিনি। তার গানের সেই সুর, সেই ভাষা এই প্রজন্মকেও মোহিত করে সমানভাবে। ৮ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গুণী আজ থেকে তিন বছর আগে ২০২০ সালের ৯ আগস্ট পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

শৈশবেই সংগীত-যাত্রার শুরু

১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন আলাউদ্দিন আলী। পরিবারের সুবাদে ছেলেবেলা থেকেই সংগীতের সাথে পরিচয় তার। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় চাচার কাছে থেকে উপহার পাওয়া বেহালা দিয়েই তার সংগীতের হাতেখড়ি। সংগীত জগতে তার আবির্ভাব ঘটে বেহালাবাদক হিসেবেই। সেই থেকেই শুরু। সুরের ভুবনে এক অবশ্যম্ভাবী প্রতিভা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন তখনই।

'অল পাকিস্তান চিল্ড্রেনস প্রতিযোগিতা'য় বেহালাবাদক হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেন আলাউদ্দিন আলী। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছ থেকে গ্রহণ করেন শ্রেষ্ঠ বেহালাবাদকের পুরস্কার।

কর্মজীবনও শুরু করেন একজন যন্ত্রশিল্পী হিসেবে। সে সময়ে তিনি প্রখ্যাত সুরকার শহিদ আলতাফ মাহমুদ ও পরবর্তী সময়ে আনোয়ার পারভেজের সাহচর্যে আসেন ও তাদের সহযোগী হিসেবে চলচ্চিত্রের গানের দুনিয়ায় যাত্রা শুরু করেন। সত্তরের দশকে তিনি সেই সময়ের জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন।

দশকের পর দশক সংগীতের ভুবনে দাপুটে বিচরণ

১৯৭৭ সালে গোলাপি এখন ট্রেনে ও ফকির মজনু শাহ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। 'আছেন আমার মোক্তার,' 'হায়রে কপাল মন্দ,' 'চক্ষের নজর এমনি কইরা' - গানগুলো এখনো সবার মুখে মুখে ফেরে।

এরপর একে একে 'সুন্দরী,' 'দুই পয়সার আলতা,' 'জন্ম থেকে জ্বলছি,' 'ভাত দে,' 'রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত,' 'পদ্মানদীর মাঝি'সহ আরো দুর্দান্ত সব ছবিতে সংগীত পরিচালকের গুরু দায়িত্বটি পালন করেছেন তিনি। সুর দিয়েছেন অসংখ্য গানে। তার গানগুলোর মন-মাতানো সুর চলচ্চিত্রের প্রবাহে এনেছে অনন্য আবেদন।

কে গাননি তার গান!

এন্ড্রু কিশোর, সৈয়দ আবদুল হাদী, রুনা লায়লা, শাহনাজ রহমাতুল্লাহ, সাবিনা ইয়াসমিন ছিলেন আলাউদ্দিন আলীর ধরা শিল্পী। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে "কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না" শুনে মুগ্ধ মিতালি মুখার্জির আবদার, তিনিও এমন গান গাইতে চান। আলাউদ্দিন তাই তাকে দিয়ে গাওয়ালেন ''এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই।"

নায়ক জাফর ইকবালকে দিয়ে গান গাওয়ানোর কৃতিত্ব তারই। "সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী" এখনও গানের আড্ডায় তরুণদের মুখে মুখে ফেরে। তিনি বলতেন, আশাজী লতাজী ছাড়া এমন কেউ কোনো নেই এ উপমহাদেশে যে তার গান গাননি! সত্যিই তাই। এমন মোহনীয় সুর উপেক্ষা করে, এমন সাধ্য কারই বা আছে?

সুরের বিচিত্র সম্ভার

সুরের বৈচিত্র্য ও ভাষার উপলব্ধি আলাউদ্দিনের গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঠিক কোন দৃশ্যে কোন গানটি মানায়, তা তিনি জানতেন খুব ভালোভাবেই। জীবন-মৃত্যুর বন্ধন যেমন জোরালোভাবে উঠে এসেছে "আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার" গানে, তেমনি শ্রীকান্তর প্রতি নিখাদ প্রেমে রাজলক্ষ্মী গেয়ে ওঠে "শত জনমের স্বপ্ন।"

"ও আমার বাংলা মা তোর" অথবা "আমায় গেঁথে দাও না মাগো" গানগুলো শুনলে সুরের আশ্চর্য শৈলী হাহাকার জাগায় বুকে। বন্ধুর প্রতি অনুযোগে গেয়ে ওঠা যায় "বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম"। সুরের ভুবনে সর্বত্র বিচরণকারী এই গুণীর সৃষ্টির ঝুলিতে আরো রয়েছে "একবার যদি কেউ ভালোবাসতো", "আমার মতো এত সুখী", "ইস্টিশনের রেলগাড়িটা", "এমনও তো প্রেম হয়", "জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো", "ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা"-র মতো কালজয়ী সব গান।

প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করেন তিনি। চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন মিলে যার সংখ্যা প্রায় হাজার পাঁচেক। ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১ সালে টানা তিনবার অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

আলাউদ্দিন আলী ‘এলসিএস’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন যা শিল্পীদের রয়্যালটি ও অধিকার রক্ষায় কাজ করে। এছাড়াও  তিনি ‘একতারা মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন’ নামে  একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন যেখানে সংগীত তৈরির নানান কাজ করা হয়।

৬৮ বছর বয়স এমন এক গুণীর আয়ু হিসেবে খুবই কম। করোনার করালগ্রাসে একে একে তখন পরপারে পাড়ি জমাচ্ছেন যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। আলাউদ্দিন আলী দীর্ঘদিন ভুগছিলেন ক্যান্সারে। সেই সাথে  ফুসফুসে টিউমার ও প্রদাহ এবং শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে ২০২০ সালের ৯ আগস্ট তিনিও পৃথিবীর বাঁধন থেকে মুক্ত করলেন নিজেকে।

আবার হয়তো আমরা তার দেখা পাব শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে। ততদিন আলাউদ্দিন আলীর সুর বেঁচে থাকবে বাংলা গানে, বাংলা প্রাণে। 

maishamaliha711@gmail.com

শেয়ার করুন