Bangla
12 days ago

আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথের অজানা কথা

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

বাঙালির আপন পরিসরে যত রকমের সৃজনশীলতা থাকতে পারে তার প্রতি পথেই হেঁটেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি স্বশিক্ষিত হয়েও শিক্ষাবিদ। একই অঙ্গে বহু রসের মিশেল। তিনি কবি, ঔপনাসিক, সংগীত রচয়িতা, নাট্যকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও দার্শনিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর হয়ে ওঠা অনেকখানি আকস্মিক এবং নিছকই খেয়ালের বশ। বলা চলে বুড়ো বয়েসে মাথায় বাতিক চাপা। আজ বরং হয়েই যাক আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথের গল্প।

প্রায় পঁয়ষট্টি বছর বয়সে রবি ঠাকুর হয়তো ভাবতে বসেছিলেন, তার জীবনে যেন কী একটা করা বাকি রয়ে গেলো। সেই খেয়ালই কিনা বসলেন রঙ-তুলি নিয়ে। কাগজে এবড়ো-থেবড়ো কালির মাখামাখি, যেন শিশু খেলা করছে, এ যেন তার সৃষ্টি সুখের উল্লাস। ব্যাপারটা এখানে শুধু আঁকা নয়, বরং ভাব। তাই দেখে গুণীজনের মন্তব্য, “শিশুর মতোন কিন্তু শিশুসুলভ নয়।” 

কবির নিজের ভাষায় যদি বলি -  

‘তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে, 

নাবালক জন্ম নেবে নতুন আলোকেতে। 

ভাবনা আর ভাষায় ডোবা,

মুক্ত চোখে বিশ্ব শোভা

দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে।’

এই শিশুর মতোন খেলাগুলো আরো একটি ঘটনায় আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছোট থাকতে আমরা নিশ্চয়ই পত্রিকায় ছাপা জ্ঞানীগুণীর ছবিতে গোঁফ কেটেছি, চুল দিয়েছি, টিপ পড়িয়েছি। এই কাজটি বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথও করেছেন তাও খোদ নিজের ছবিতে। ১৯৩৪ সালে বিশ্বভারতীর পত্রিকার এক সংখ্যায় নিজের ছবির সাদা গোঁফ কালি দিয়ে কালো করে দিয়ে, আবার আরেকটা গোঁফ দাড়ি মুছে নিজেকেই মেয়ে মানুষ বানিয়ে ফেললেন। 

শান্তিনিকেতনের আশ্রমে নিভৃতে যখন ছবি এঁকেছেন, কখনো কখনো দেখে ফেলেছেন রাণী চন্দ। দেখছেন আস্ত একখানা ছবি এঁকে পুরো কালি ঢেলে আবার সেই ছবি উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। এক্কেবারে ছেলে খেলা অবস্থা। 

কবির ছবি আঁকার জিনিসের ছিল না কোনো ঠিকঠিকানা না কোনো বাছবিচার। কখনো কলম, কখনো পেন্সিল, কখনো তুলি। এমনকি ওভারকোটের হাতায় রঙ মেখে চলত আঁকা! আবার প্যাস্টেলের ঘষে ঘষে মাঝে জল রং ঢেলে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন।

ছবি : ফ্রি প্রেস জার্নাল 

চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সকল আর্ট ভালো করে নিরিখ করলে সময় অনুযায়ী তাদের মধ্যে কতোগুলো ধাপ দেখতে পাওয়া যায়। এই মন্তব্যটি শিল্পী রতন পরিমুরের। 

তিনি বলেন ১৯২৪ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত রবির আঁকা শুধুই রেখার কাটাকুটি। এরপরে সাদা-কালোর পরিসীমা পেরিয়ে রঙিন ছবিতে ঢোকেন ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ এর ভেতর। রবি ঠাকুরের আঁকায় জীবন সাদৃশ্যতার আভাস পাওয়া যায় ১৯৩৫ থেকে ১৯৪১ এর সময়কালে। রবীন্দ্রনাথের ছবি মধ্যে থাকতো নানা রকমের মুখ, কাল্পনিক প্রাণী, প্রাগৈতিহাসিক অবয়ব, মুখোশ, যৌথ মানুষের মুখচ্ছবি বা নেহাতই কিছু হ-য-ব-র-ল। তাতেই আবার ধীরে ধীরে এসেছে অতিপ্রাকৃত বা কিছু কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য বা মানবের শরীরী ছবি। কবি নিজের চিত্রকলা শিরোনামহীন রাখতেন। তিনি মনে করতেন ছবি দেখে যা মনে হয়, সেটি তাই। নাম দিলে লোকে শুধু ছবিটি এক দিকেই খোঁজার চেষ্টা করে। 

ছবি : ফ্রি প্রেস জার্নাল 

রবি ঠাকুরের শৈশব থেকেই টান ছিল ছবির প্রতি। যেকোনো ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন, কিন্তু কখনো নিজে চিত্রশিল্পী হবেন কিংবা আঁকা শেখায় মন দেবেন তেমনটা ভাবেননি কখনোই। অবশ্য যদি রবীন্দ্রনাথের গোটা আঁকাআঁকির ইতিহাস বলতে হয়, তবে নিজের কবিতা লেখার খেরোয় শব্দের মাঝে মাঝেই বেশ ভালোই ডুডল কাটতেন। বলা চলে তার আঁকার শখ ওই দিয়েই শুরু। 

মালতী, পূরবী, রক্তকরবীর পাণ্ডুলিপিতে ঐরকমটি দেখতে পাওয়া যায়। ব্যাপারটি বেশ যত্ন নিয়ে দেখেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো যখন কবি আর্জেন্টিনায় প্রবাসে ছিলেন। কবিতায় খসড়ায় যদি কোনো পংক্তি বা শব্দ বাদে চলে যেতো তো সেগুলো কবির হাতের নান্দনিক কাঁটিকুঁটিতে ঠাঁই পেয়ে যেতো নতুন শিল্প বলয়ে। 

রবীন্দ্রনাথ কখনোই চাননি তার শিল্পকর্মের প্রদর্শনী এদেশে হোক। তিনি মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, “আমার ছবি এদেশের লোকের জন্যে নয়, অন্তর্দৃষ্টি নেই যে।”  মাত্র ১৫ বছরের শিল্পী জীবনে এঁকেছেন আড়াই হাজার ছবি। ১৯৩০ থেকে তার ছবি গুলির প্রদর্শনী হতে থাকে লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, ড্রেসডেন, মিউনিখ, কোপেনহেগেন, মস্কো, বোস্টন, জেনেভা, নিউইয়র্ক আর ফিলাডেলফিয়াতে।

বিশ্ব শিল্পবোদ্ধাদের সমালোচনার ঝড় উঠে যায়, হোক নেতিবাচক বা ইতিবাচক। কেউ বলেছেন যা-তা, আবার কেউ খুঁজে পেয়েছেন এক্সপ্রেশনিজমের নয়া দিগন্ত। অধিকাংশ তার্কিকের মত, রবীন্দ্রনাথই প্রথম এদেশে আধুনিক বিমূর্ত চিত্রকলাকে ঠাঁই দিয়েছেন

ছবি : ফ্রি প্রেস জার্নাল 

কবির ছবিতে কালো রঙের মিশেল বেশি হতো। সব ছবি যেন খুব বিষণ্ন। তবে কোনোটিই একেবারে মৌলিক রঙ নয়, অনেক রঙের মিশেলে তার জন্ম। বলা যায়, এর একটি কারণ ঠাকুরের বর্ণান্ধতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ প্রোটোনোপিয়াতে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি লাল আর সবুজে খুব আলাদা করতে পারতেন না। অথচ এই সবুজই তার প্রিয় রঙ। লাল রঙয়ের বেশির ভাগ তিনি নেগেটিভ স্পেস দেখতে পেতেন। সবচেয়ে ভালো বুঝতেন নীল রঙ। ঘাসের মাঝে একেবারে ছোট্ট নীল ফুল থাকলে সেটিও তার চোখ এড়াতো না।

জীবন শেষের দিকে তিনি কবিতা লেখা একেবারে ভুলতে বসেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন, ছবি আঁকা তার শেষ বয়সের প্রিয়া। সারাজীবনের যে কাজেই খ্যাতি কুড়িয়েছেন, শেষ অল্প কটা বছরে চিত্রজগতে প্রবেশ করেই তার চেয়ে খুব তাড়াতাড়ি করে প্রশংসা ঝুলিতে ভরেছেন।

[email protected] 

শেয়ার করুন