Bangla
2 years ago

আশি পেরোনো টম অ্যান্ড জেরি এখনো সবার প্রিয়

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

একটি অলস আরামপ্রিয় বিড়াল যে শুধুই নিজের মতো শুয়ে বসে দিন কাটাতে ভালোবাসে, কিন্তু তার সুখ-আরাম ভেস্তে দিতে সদা প্রস্তুত একটি ছোট্ট বুদ্ধিপাকা ইঁদুর। তার অত্যাচারে বিশালাকায় ছাইরঙা বিড়ালটি সদাই নাস্তানাবুদ।

তাই বলে বসে নেই বিড়ালটি, সে ইঁদুরটাকে শায়েস্তা করতে নিত্যে নতুন ফন্দি ফিকিরে রত। এমনি নাট্যে আজো ছেলে-বুড়োর মন ভরিয়ে আসছে বিড়াল টম আর ইঁদুর জেরির দুষ্ট-মিষ্টি লড়াই। 

পথচলার ৮২টি বছর কাটিয়েও জনপ্রিয়তা ম্লান হয়নি এতোটুকু। দেখতে বসলেই হারিয়ে যেতে হয় নস্টালজিয়াতে। 

সারাবিশ্বে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম টম আর জেরির এই হলিউডি কার্টুন সিরিজ দেখে বড় হয়েছে পুরো আটটি দশক ধরে। কিন্তু মজার বিষয় এর নির্মাতারা স্বপ্নেও ভাবেননি তাদের বানানো কার্টুন সিরিজ এভাবে অমরত্ব পাবে।

১৯৩৭ সালের আগস্টে কার্টুন চলচ্চিত্রের স্টুডিও মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার প্রতিষ্ঠা লাভ করে ফ্রেড কুইম্বলির হাত ধরে। তার কিছু পরেই এতে কাজ পেয়ে যান লেখক এবং চরিত্র নির্মাতা উইলিয়াম হ্যানা এবং পরিচালক  জোসেফ বারবারা। এই জুটি প্রথমে জাহাজি এক নাবিকের চরিত্রকে কেন্দ্র করে বানিয়েছিল এক কার্টুন সিরিজ ‘ক্যাপ্টেন এন্ড দ্য কিডস’। কিন্তু এই কার্টুনটি একটুও আশার আলো দেখেনি। 

      স্টুডিওতে কর্মরত হ্যানা আর বারবারা

তারপরে হ্যানা নতুন কিছু করতে ইঁদুর বিড়াল নিয়ে কিছু ভাবতে বসেন। সেই ভাবনা থেকে পর্দায় নামে পুশ গেটস দা বুট,  যার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকে জ্যাসপার নামের বিড়াল আর জিনক্স নামের দুষ্ট ইঁদুর। কার্টুনটি প্রথম মুক্তি পায় ১৯৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি।

সমসাময়িক কালে ইঁদুর বিড়াল নিয়ে বেশ কিছু শর্টস তৈরি হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি ছিল সম্পূর্ণ নির্বাক এবং ছিল না কোনো আবহ সঙ্গীত। 

তাই হ্যানা আর বারবারার এই সৃষ্টি নিয়ে তাদেরই সহকর্মীরা খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন না। অনেকেই আগের ব্যর্থতার জের ধরে নাক সিঁটকোতে লাগলেন। বের হয়ে আসলেন দল হতে। হ্যানা আর বারবারা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু তখনই কিছু প্রেক্ষাগৃহ হতে ইতিবাচক সাড়া আসতে শুরু করে। প্রেক্ষাগৃহ অধিকর্তাদের মনে ধরলো খুব, তারা এ ধরনের চিত্র প্রদর্শনে উৎসাহ জানালো। 

হ্যানা আর বারবারা যেনো নতুন উদ্যম ফিরে পেলেন। জ্যাসপারের চেহারায় কিছু বদল করা হলো, একটা মসৃন অবয়ব পেলো বিড়ালটি, অনেকটাই রাশিয়ান ব্লু ক্যাটের মতো। সাথে একটা নতুন নাম টম। আর জিনক্স এর আকারে প্রকারে তেমন কোনো ব্যতিক্রম না আসলেও নামটি বদলে হয়ে গেলো জেরি। নাম দুটি ঠিক করে দিয়েছিলেন এনিমেটর জন কার। তার প্রেরণা ছিল প্রিয়ার্স এগানের লেখা লাইফ ইন লন্ডন এর দুটি চরিত্র। পরবর্তীতে তাকে এই নামের জন্যে ৫০ ডলার দক্ষিণা দেয়া হয়েছিল। 

একবার এই টম জেরির গল্প প্রেক্ষাগৃহে নামার পর মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার (এম.জি.এম)  কোম্পানিকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ফ্রেড কুইম্বলি স্বয়ং একের পর এক সিরিজ প্রযোজনার দ্বায়িত্ব নেন। ১৯৪১ সালেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সেই স্বনামধন্য ওয়াল্ট ডিজনিকে পেছনে ফেলে সেরা শর্ট ফিল্মের জন্য একাডেমি আওয়ার্ড অর্জন করে টম আর জেরি, যা ছিল এম.জি.এম এর সবার আশাতীত। 

টম আর জেরির গল্পে শুধুই তারা দুজন আছে এমনটা নয় কিন্ত। স্পাইক নামে একটা রগচটা কুকুর যে তাড়া করে বেড়ায় টমকে। স্পাইকের সাথে থাকে টাইক নামে এক ছোট্ট ছানা। আছে বুচ নামে এক কৃষ্ণ বিড়াল, যে মাঝে মাঝে ইঁদুরকে শায়েস্তা করতে টমকে সাহায্য করে।

আবার জেরির সঙ্গী হিসেবে দেখা যায় ভীষন আদুরে এক অনাথ ইঁদুরছানা নিবলস। আর টমের প্রেয়সী সুন্দরী বিড়াল টুডলস, যাকে টম প্রেম নিবেদন করতে গেলেই জেরি বাগড়া বসায়। টমের বাড়ির মালকিন ম্যামি টু শুস, যার ভয়ে সিঁধে থাকে টম, এর  মুখটি দেখা না গেলেও ধর থেকে পা অব্দিই শুধু দেখতে পায় দর্শকরা। 

এম.জি.এম তাদের সৃষ্ট একটা নিজস্ব সুর বাজিয়ে শুরু করতো কার্টুনটি। ছোট বড় সবারই ভালো লেগে যায় কার্টুনটি। ১৯৪২ সালে ডেল কমিকসের পক্ষ থেকে কমিক বই হিসেবে প্রকাশ পেতে থাকে টম এন্ড জেরি। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও নরওয়ে, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস আর অস্ট্রেলিয়াতে ভালোবাসা কুড়াতে থাকে এই দুষ্টমিষ্টি ইঁদুর বিড়াল।

টম এন্ড জেরি নিয়ে প্রকাশিত বই 

কিন্তু ১৯৫০ সালে হঠাৎ করেই এম.জি.এম এর আয় কমতে শুরু করে। তবুও হ্যানা আর বারবারা হাল ছাড়েন না। কিন্তু ১৯৫৮ সালে চিরতরেই বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানিটি। এই ১৯৪১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সফরে মোট ১১৪টি ক্ষুদে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এগুলোকে টম আর জেরির অরিজিনাল ভার্সন গণ্য করা হয়।

কিন্তু এই অলস বিড়াল আর হিংসুটে ইঁদুরের লড়াইয়ের আবেদন কিন্তু একটুও কম হয়ে যায়নি। তাই রেমব্রান্ট ফিল্মস এর তরফ থেকে জিন ডিচ ১৯৬১ থেকে ৬২ এর মধ্যে বেশ কিছু শর্টস তৈরি করেন, সেবার তারা লুনি টুনসকে ছাড়িয়ে যায়।

এরপরে সিব টাওয়ার প্রোডাকশন কথা বলা টম জেরি নিয়ে আসে। সেখানে টমের টুকটাক শব্দের কন্ঠ দিয়েছিলেন উইলিয়াম হ্যানা নিজে। 

এই জনপ্রিয় সিরিজটিতে সভ্য জনের কিছু কটাক্ষ এসে টোকা দেয়। এতে নাকি টম জেরিকে মারতে চেয়ে বারুদ, কুঠার, ধারালো ছুরি, বোমা, হাতুড়ি, করাত ইত্যাদি ভয়াবহ অস্ত্রের ব্যবহার হয়, যা নাকি শিশুমনের জন্যে হানিকর। এছাড়া নাকি বোমার আক্রমণ তাদের যে চেহারা দেখানো হয় তা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে অপমান।

কিন্তু এইব আরোপের থোড়াই পাত্তা দিয়েছে দর্শক। তাদের প্রত্যেকের দাবি তারা ইঁদুর বিড়ালের এই লড়াই দারুন উপভোগ করেছেন আর হেসেছেন খুব। টম আর জেরি যে কেবলই সংগ্রামে লিপ্ত তা নয়, কখনো বিপদে পড়লে পরস্পরের পাশে থেকে সাহায্য করে বটে। 

টেলিভিশন সিরিজ আকারে টম এন্ড জেরি আসে ১৯৭৫ সালের দিকে। ১৯৮৫ সালে প্রথম ফ্রাঞ্চাইজি লোগো হয় এই কার্টুনের, লোগোতে কিন্তু এই চিরবৈরিকে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি মুখেই দেখা যায়।

নব্বইয়ের দশকে টম আর জেরি দুইজনকেই শৈশব রূপ দিয়ে একটি সিরিজ চালু হয় টম এন্ড জেরি কিডস শো । প্রথমবার সিরিজ থেকে বের হয়ে মুভিও মুক্তি পায় এসময়।

বতর্মানেও টম জেরি চলছে সেই তালেই, তবে এখন তা ওয়ার্নার ব্রোসের ব্যানারে। ২০০৬ সালে ওয়ার্নার ব্রোস টম এন্ড জেরির স্বত্ব কিনে নেয়। 

roysushmitadiba@gmail.com 

শেয়ার করুন