প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
জমকালো রোশনাইয়ে সজ্জিত এক দালান, ফুল আর থার্মাকলের সাজ, কান পাতলেই সানাইয়ের ধ্বনি। বাড়িভর্তি অভ্যাগতের ভিড়।
মোটামুটি নব্বইয়ের দশক অব্দি যাদের বেড়ে ওঠা, শুধু একটুকু বললেই তারা বুঝে যাবেন কথা হচ্ছে বিয়ে বাড়ি নিয়ে। সেকালের বিয়েবাড়ির থেকে আজকের বিয়েবাড়ির হয়েছে আমূল পরিবর্তন। তবে এখনো বিয়ে বাড়ির কথা উঠলে যেটা বদলায়নি তা হলো বিয়ের নেমন্তন্ন মানেই খেতে হবে পেট পুরে। বর-বউকে ঠিক করে দেখা হয়নি, কিন্তু খাবার টেবিলে বসাটা ঠিক হয়ে গেছে।
সে বাঙালি চিরকালই খাদ্য রসিক, একথা মানতেই হবে। তবে পরিবর্তনটা এসেছে বাঙালির খাদ্য তালিকার পদে। সেই আটশো বছর থেকে আজকের দিন যেভাবে বাঙালির রুচি বদলেছে সেভাবেই বদলে গেছে পদের ক্রমণিকা।
এক সময়ে বাঙালির বিয়ের ভোজে যেখানে ভাত-ডাল স্থান পেতো আজকের দিনে সেটা বলাই চলে কোর্মা-পোলাওয়ের দখলে, আবার নতুন নতুন পাতে উঠছে চৈনিক থেকে কন্টিনেন্টাল, বাঙালির রুচির বৈচিত্র্যের বলিহারি যাই।
তবে আজকের আলোচনা ঠিক বুঝতেই পেরে গেছেন যখন, দেরি না করে পাত পেড়ে বসে পড়ুন।
আজ যদি বলা হয় বিয়ে বাড়ির দাওয়াত তো চোখের সামনে ভেসে উঠবে মুরগির রোস্ট, জালিকাবাব, একটা রেজালার সাথে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা পোলাও। এর থেকে বেশি মাছের প্রতি টান থাকলে একখানা দোপেঁয়াজা। সঙ্গে থাকতে পারে চৈনিক হেঁশেলের সবজির পদ আর ইউরোপের কাছে ধার করা সালাদ।
পানীয় হিসেবে বোরহানি কিংবা বুদবুদ ওঠা কোমল পানীয়। মিষ্টান্ন পদে জর্দা আর ফিরনি। আর সবশেষে বড়জোর মশলাদার পান বা ধনিয়া মৌরি আর জোয়ানের মুখশুদ্ধি। মোটামুটি আজকের দিনের সব বিয়েবাড়ির খানা এই।
কিন্তু বাঙ্গালীর বিয়ের ভোজ কত বৈচিত্র্যে ঠাসা তা দেখতে গেলে তো একটু ইতিহাসের পাতা ওল্টাতেও হয়।
খুব বেশি দূর যেতে হবে না; এই একশো-দুশো বছর আগেরকার পদ শুনেই চোখ কপালে উঠবেই।
লেখিকা শরৎকুমারীর প্রবন্ধ হতেই দেখা যায় পোলাউয়ের সাথে নানান মাছের পদ- কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়ে ছোলার ডাল, রুইয়ের মাথা দিয়ে মুগের দল সঙ্গে সবজি পদে আলুর দম, ছক্কা, ছ্যাঁচড়া, লাবড়া।
একটু বনেদি ঘরের তো আরো চমৎকার- মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা, পটল ভাজা, মাছ, দই, চাটনি, লুচি, কচুরি ও পাঁপড় ভাজা। মিষ্টি মুখে আমসন্দেশ, তালশাঁস, বরফি, ক্ষীর দই, রাবড়ি, ছানার পায়েস।
তখনের দিনের ধনী মুসলিম পরিবারে খানা পিনায় হতো রকমারি কাবাব, নানান মসল্লায় মাংসের পদ, ডিমের কোর্মা লাজাবাব সব রান্না। সঙ্গে সুগন্ধি বাদাম শরবত।
সত্তরের দশক ছুঁতেই ছ্যাঁচড়া যুগের পতন ঘটে যায়। বিয়ে বাড়ির হাঁড়ি থেকে লাবড়া, ছ্যাঁচড়া, শাকভাজা চিরতরে কর্পূরের মতো উবে যায়। গ্রামীণ বিয়েতেও তা চোখে ধরা দেয় না।
আরেকটু পেছনে গেলে অবাক হতে হয় আরো। ধরা যাক সাড়ে আটশো বছর আগে পন্ডিত শ্রীহর্ষ আমাদের জানাচ্ছেন সব খাবারের মধ্যমণি ভাতের কথা। আজকের যুগে যা পোলাও, সেই যুগে তা ভাত, তবে যেমন তেমন ভাত নয় -ঝরঝরে অভগ্ন, শুভ্র, সুস্বাদু গরম ধোঁয়া ওঠা ঘি ভাত।
বাঙালির কিন্তু কোনো কালেই ভোজের পাতে কেবল সবজি দ্রব্য পছন্দ নয়, কারন এতো সেই রোজকার খাওয়া। একটু আমিষ পাতে না পড়লে চলে! এক পালাতে পাওয়া যায় - বিয়ের দিন সবুজ পাত্রে খাবার পরিবেশিত হয়েছিল, যাকে সবজি ভেবে নাক সিঁটকেছিল উপস্থিত অতিথিরা।
প্রাচীন যুগের মঙ্গলকাব্যে বেহুলার বিয়ের পদে পাওয়া যায় ঘিয়ে ভাজা খাসির মাংস, হরিণের মাংস, মরিচ দিয়ে ভেড়ার মাংস, কবুতরের মাংস আর অম্বলের কথা।
আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি কিনা। মধ্যযুগে মাছের পদে দেখা মেলে কই রুই কাতলা পাবদা চিতলের। তেল কই, চিতলের পেটি আর মরিচ-লবঙ্গে মাছ ভাজি, আহা যেন মরি মরি। মাংসের পদে মৃগ মাংস, ছাগমাংস আর নানান পাখির মাংসের পদ, যার সাথে পরিবেশিত হতো নানান দেশের বাণিজ্যতরীতে ভেসে আসা মশলা আর সুগন্ধিযুক্ত ব্যঞ্জন। হতো দই আর রাই সর্ষের হলুদ ছাড়া ঝাল ব্যঞ্জন, কে জানে সেটা আজকের দিনের রায়তার আদিম সংস্করণ কিনা।
মিষ্টান্নে তো পায়েস চাই-ই-চাই। আজকের মতোন রসগোল্লা, চমচম, ছানার সন্দেশ হতো না বটে, মিষ্টিতে থাকতো নানা ধরনের পিঠে-পুলি, রসে সিক্ত মুগের বড়া, কলার বড়া আর চিনি নারকেল আর ক্ষীরের ছাপতোলা সন্দেশ। পানীয় ছিল কর্পূর মিশ্রিত সুগন্ধি জল বা পানা। মুখশুদ্ধিতে কস্তুরী আর কর্পূরদানা মিশ্রিত পান, ভাবা যায় কত্তো দুর্লভ বস্তুতে তৈরি!
খাবারের পাতে যেমনি পরিবর্তন তেমনি পরিবর্তন খাবারের পরিবেশনায়। এখন তো সব খানে চীনামাটির পাত্র। আর সেকেলে সব কিছু পরিবেশন হতো কলাপাতা, পদ্মপাতা, শালপাতা কিংবা মাটির থালায়।
শুধু খাওয়াতে নয়, কনে বাড়ির আতিথ্যেয়তা ছিল মনে রাখবার মতন। সেই যুগে তারা গলবস্ত্র হয়ে অতি বিনয়ে খাবার পরিবেশন করতেন। খেয়াল রাখতেন হয় যেন না ত্রুটি। আর বরপক্ষ যা চাই, হাত বাড়ালেই তাই পাই।
বিয়ের খাবার তো কব্জি ডুবিয়ে আয়েশ করে খাওয়া চাই। তবে কিনা সেকেলে লোকে খাইয়ে হতো এক্কেবারে গান্ডে-পিণ্ডে গেলবার মতো। এক কেজি মাংস, কুড়ি টুকরো মাছ, পঞ্চাশ-ষাটটা রসগোল্লা গেলা মানুষ এ যুগে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে না এখন।
তবে এদের থেকে কন্যার পিতাকে রক্ষার উপায় করতেন রাঁধুনি ঠাকুর। পোলাও ঘি মেরে মেরে এমন ভারী করে দিতো যাতে বেশি মাছ-মাংস টানতে না পারে। মাংস একটু রেখে সিদ্ধ মানে শক্ত রেখে সরুয়ায় ছেড়ে দিতো। বিশ কেজি মাংসতে অনায়াসে আড়াইশো লোকের রান্না হয়ে যেতো। আজকাল বিয়েতে বুফে থাকলেও এতো খাওয়ার মানুষ নেই, খাবার ফেলাই যায় বরং।
তাই খাবার অপচয় না করে তা দুস্থদের মাঝে দান করার মহতী উদ্যোগ নেয়া যেতেই পারে কিন্তু।
roysushmitadiba@gmail.com