প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
এস.এম. শাদমান, নিজের ফেসবুক টাইমলাইন স্ক্রল করছিলেন। স্ক্রল করতে গিয়ে দেখেন তার বন্ধুর ছবি। কালো টি-শার্টের ওপর বাদামী রঙের জ্যাকেট পেছনে আইফেল টাওয়ার। ক্যাপশনে লেখা, “পরিশ্রম করলে সবই সম্ভব, পড়াশোনার জন্য মানুষ সদূর চীন দেশে যায় আমি এসেছি প্যারিসে।”
কলেজে চার বিষয়ে ফেইল করা সাকিবের এই বন্ধু প্যারিসে গিয়েছে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে- এই ভেবে বুকভরা হতাশা আর শুভকামনা নিয়ে লাভ রিয়েক্ট দিলো বন্ধুর পোস্টে।
চার সদস্যের পরিবারে শাদমান দুই ভাইদের মধ্যে বড়। চাকরি করেন একটি কনসালটেনসি ফার্মে। স্কুল ও কলেজে প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের একজন হলেও দেখেছেন একে একে নিজের বন্ধুদের বিদেশ পাড়ি দেয়ার গল্প। তাদের দেখে শাদমানেরও বিদেশে স্বপ্নের ক্যারিয়ার গড়ার সাধ জাগে কিন্তু তিনি পারেন না। তিনি পোস্ট করেন তার তিন’শ ফিটে যাওয়ার ছবি।
শাদমানের জীবনের বাস্তবতা আর তার বন্ধুুদের বাস্তবতা কি এক? বন্ধু বিদেশ যাচ্ছে তাই বলে শাদমানেরও কি বিদেশেই যেতে হবে? শাদমানের জায়গায় নিজেকে রেখে এসব প্রশ্ন কখনো করেছেন পাঠক?
যদি প্রশ্ন করা হয় বিদেশে যাওয়ার জন্য কী প্রয়োজন, তাহলে উত্তরে কী কী আসতে পারে? পাসপোর্ট ও ভিসা তো অবশ্যই। এর বাইরে কী প্রয়োজন- অর্থ? জ্বি, বিদেশে যাওয়ার জন্য যেটা অন্যতম বিবেচ্য তা হলো আপনার আর্থিক সামর্থ্য।
আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউকে, জার্মানি – সেখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আপনি করতে পারবেন কি-না। বৃত্তির মাধ্যমে যদি সে ব্যবস্থা হয়েও যায় বিমানের ভাড়া, জি আর ই, আইইএলটিএসের পরীক্ষাগুলো দেয়ার খরচ থেকে শুরু করে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য লাখ খানেক টাকা এসব কিছুর কতটা যোগান আপনি দিতে পারবেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
জীবনের বাস্তবতা বনাব বন্ধুর বিদেশে যাওয়
আমাদের সবার ক্যারিয়ার গোল, জীবনের উদ্দ্যেশ্য ও বাস্তবতা সমান নয়। আপনার জীবনের বাস্তবতা যদি অনেকটা এস. এম. শাদমানের মতো হয় তাহলে দেশেই হয়তো ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে নেয়া ভালো।
মা-বাবা, ছোট ভাইবোনের ভবিষ্যত, পরিবারের হাল ধরা যেকোনো সংগ্রাম ও যুদ্ধের থেকে কম নয়। মা-বাবার বয়স হলে সন্তানই হয় তার একমাত্র ভরসা। তাদের অসুস্থতা ও ভালো-মন্দ দিনে সন্তানের পাশে থাকা অন্য যেকোনো আত্মীয়স্বজন ও কাছের মানুষ থেকে বেশি জরুরি। আর্থিক সঙ্কটের থেকে নিজের জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে বন্ধুর জীবনের বাস্তবতা মেলালেই বোঝা যাবে আকাশ-পাতাল ফাঁরাক।
নিজের ব্যাপক ইচ্ছে ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শাদমান দেশে থাকাই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিদেশে যাওয়ার জন্য আমি মানসিকভাবে সব সময়ই প্রস্তুত ছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। তবে পারিবারিক নানান টানাপোড়ন, বাসার দায়িত্ব আমাকে জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। আমি একা একজন হলে হয়তো সম্ভব ছিল; তবে আমার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সামগ্রিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে।”
আপনার আর বন্ধুর ক্যারিয়ার গোল কি এক?
বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য এ বিষয়টি খেয়াল রাখা বেশ জরুরি। বর্তমানে যেকোনো বিষয়ে পড়তে হলেই যে কেউ বিদেশে যাওয়াকেই অগ্রাধিকার দিবে এটা স্বাভাবিক। তবে আপনার ক্যারিয়ার গোল যদি দেশে পরিবারের সঙ্গে থেকেই অর্জন করা যায় তাহলে বিদেশে যাওয়ার চিন্তা কিছুটা হলেও অমূলক। আপনার ক্যারিয়ারের উদ্দ্যেশ্যই ঠিক করে দিবে এর পথটা কোথায় ও কেমন হবে বা হওয়া উচিত।
নিজেকে জানা
প্রবাস জীবন এতোটাও সহজ নয় যতটা ফেসবুকের ছবিতে দেখা যায়। কেউ কেউ না খেয়ে কাটায় দিনের পর দিন, অসুখ হলে যত্ন নেয়ার কেউ থাকে না। অনেকেই ফিরে আসে নিজ দেশে।
মশিউর রহমান, যিনি পেশায় একজন ফ্রিল্যান্সার, নিজেকে বিদেশে যাওয়ার যোগ্য মনে করেন না। তিনি বলেন, “আমি আমার প্রথম চাকরিতে নেত্রোকোণায় থাকার সুযোগ পাই। এক মাসের বেশি থাকতে পারিনি। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে আমি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। এছাড়া পরিবার থেকেও কখনো দূরে থাকিনি। তাই বেতন ও সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত থাকলেও আমি মানসিকভাবে অবসাদ বোধ করতাম। তখন বুঝতে পারি বিদেশ যাওয়া আমার জন্য নয়।”
সুস্থ ও সুখী জীবন সম্পর্কে একটি কথা বেশ প্রচলিত। সেটি হলো কখনো অপরের অর্জন ও জীবনের সঙ্গে নিজের অর্জন ও জীবন তুলনা করতে নেই। একজন হয়তো বিদেশে পড়তে গিয়েছেন, ফেইসবুকে ছবি দিচ্ছেন আইফেল টাওয়ারের সামনে, কিন্তু এর জন্য তাকে অনেক সংগ্রামও করতে হয়েছে, তার পথটাও ভিন্ন।
কেউ বাইরে গিয়ে নিজের আপনজনের হাসি-খুশী মুহূর্ত কাছ থেকে দেখতে পায় না। অনেকে বয়ে বেড়ান আপনজনকে শেষবারের মতো না দেখতে পারার হতাশা নিয়ে। তাই, ‘সকলেই বিদেশে চলে যাচ্ছে, আমিও যাবো কি-না,’ এই সিদ্ধান্ত নেবার সময় যে বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখতে হবে তা হলো: সবার জীবনের গতিপথ একরকম নয়।
mohd.imranasifkhan@gmail.com