Bangla
2 days ago

বৈদ্যুতিক ইল মাছ: বায়োলজিকাল ব্যাটারি

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

কল্পনা করুন, রাতের অন্ধকারে এক বিজ্ঞানী বসে আছেন তাঁর ল্যাবে। সামনে একটি বিশাল অ্যাকুয়ারিয়াম। পানির ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি রহস্যময় মাছ। আচমকাই সে ল্যাবের বাতি নিভে যায়। কিন্তু অন্ধকার নয়, হঠাৎ চারপাশ আলোয় ঝলমল করে ওঠে। বিজ্ঞানীর চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হয় এক বিস্ময়! হ্যাঁ, মাছটা নিজেই আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে মাছের নাম — ইল ফিশ, বৈজ্ঞানিক নাম ইলেক্ট্রিফোরাস ইলেক্ট্রিকাস। একে বলা হয় “বায়োলজিকাল ব্যাটারি।”

অবাক কাণ্ড, মাছ বিদ্যুৎ দেয়!

আমরা তো জানি, বিদ্যুৎ আসে পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে। সুইচ চাপলে বাতি জ্বলে, ফ্যান ঘুরে। কিন্তু ভাবুন তো, যদি একটা মাছ তার শরীর থেকেই বিদ্যুৎ তৈরি করে? শুনতে সিনেমার মতো লাগলেও, ইল মাছ সত্যি-সত্যিই এমনই করে।

ইল মাছ দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদী ও আশপাশের জলাভূমিতে বাস করে। এর দৈর্ঘ্য ৮ ফুট পর্যন্ত হতে পারে, ওজন ২০ কেজি পর্যন্ত। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই মাছ একসাথে ৬০০ ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছাড়তে পারে! এত বিদ্যুৎ দিয়ে ছোটখাটো একটি বাল্ব জ্বালানো বা একটা মোবাইল চার্জ দেওয়া সম্ভব!

এই বিদ্যুৎ আসে কোথা থেকে?

এবার সিনেমার ভিতরের বিজ্ঞানের দিকে আসি। ইল মাছের শরীরের ভেতরে রয়েছে বিশেষ ধরনের কোষ, যেগুলোকে বলে ইলেক্ট্রোসাইট। এই কোষগুলো একেকটা ছোট ব্যাটারির মতো কাজ করে। যখন অনেকগুলো ইলেক্ট্রোসাইট একসাথে সক্রিয় হয়, তখন পুরো শরীরটাই যেন এক পাওয়ার ব্যাংকে পরিণত হয়। মাছটা যখন শিকার করে বা আত্মরক্ষায় প্রস্তুত হয়, তখন এই কোষগুলো একসাথে কাজ করে ও বিদ্যুৎ তৈরি করে। এই শক্তি দিয়ে সে শিকারকে প্যারালাইজ করে ফেলে, যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভির সুপারহিরো শত্রুকে শক দিয়ে ফেলে দেয়।

পানির ভেতর বিদ্যুৎ — বিপদজনক নয় তো?

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে — বিদ্যুৎ তো পানিতে ছড়িয়ে যায়, তাহলে ইল মাছ নিজেই তো শক খেয়ে ফেলার কথা! না, এই মাছ প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি। এর শরীর এমনভাবে গঠিত যে সে নিজের শরীর থেকে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ নিজে অনুভব করে না। ঠিক যেমনভাবে ইলেকট্রিক ইল নিজের শক নিয়ন্ত্রণ করে, তেমন আমরা সুইচ দিয়ে ফ্যান চালু করি আবার বন্ধ করি।

মানুষ কী শিখছে এই মাছের কাছ থেকে?

যেমন সিনেমায় সুপারহিরোর শক্তি দেখে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নতুন প্রযুক্তি তৈরি করে, ঠিক তেমনই বৈজ্ঞানিকরাও ইল মাছের ক্ষমতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন ধরনের ব্যাটারি বানানোর চেষ্টা করছেন। যাকে বলে “বায়োইন্সপায়ার্ড টেকনোলজি।”

বায়োলজিকাল ব্যাটারি মানে হলো এমন ব্যাটারি, যেটা মানুষের শরীরে বসানো যাবে — যেমন হৃদপিণ্ডের পেসমেকার, বা কৃত্রিম চোখের যন্ত্র। ইল মাছের ইলেকট্রোসাইট কপি করে বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের ব্যাটারি বানানোর চেষ্টা করছেন, যা জৈবিক শক্তি দিয়ে কাজ করবে, বিদ্যুৎ ছাড়াই। ভাবুন তো, ভবিষ্যতে যদি ফোনও চলে শরীরের শক্তিতে!

অন্ধকারের সুপারহিরো

যেমন ব্যাটম্যান রাতে বের হয় অপরাধ দমনে, তেমন ইল মাছও রাতে সক্রিয় হয়। সে শিকার খুঁজে বেড়ায়, আর প্রয়োজন হলে শক দিয়ে অজ্ঞান করে দেয়। আবার বিপদের সময় শত্রুকে ভয় দেখাতেও ইল মাছ হালকা শক দেয়। একেকটা শট যেন সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য — বিদ্যুৎ ছুড়ছে আর প্রতিপক্ষ কাঁপছে!

কেউ কেউ বলে, একবার একজনে নাকি ভুল করে এই মাছকে হাতে ধরেছিল — সঙ্গে সঙ্গে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। যদিও এটা একটু বাড়িয়ে বলা হতে পারে, কিন্তু সতর্ক না থাকলে ইল মাছের শকে মানুষ আহত হতেই পারে।

শেষ দৃশ্য : আমাদের ভবিষ্যৎ

যে বিজ্ঞানীর কথা দিয়ে লেখাটি শুরু, কল্পনার শেষ দৃশ্যে তার গবেষণায় সাফল্য দেখতে পাবেন। ইল মাছের বিদ্যুৎ প্রযুক্তি দিয়ে বানানো হয়েছে এমন এক ব্যাটারি, যা হৃদযন্ত্র চালাতে সক্ষম। আর সে ব্যাটারি এখন রপ্তানি হচ্ছে চাঁদে পাঠানো রোবট মিশনে!

আমরা আজ যে ইল মাছটিকে শুধু অদ্ভুত ভেবে এড়িয়ে যাই, সেই মাছই হতে পারে ভবিষ্যত প্রযুক্তির অনুপ্রেরণা। ঠিক যেন সিনেমার সেই অবহেলিত চরিত্র, যে একদিন সবার জীবন বদলে দেয়।

শেষ কথা

ইল মাছ শুধু মাছ নয়, সে এক জীবন্ত রহস্য। সে এক চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর সে-ই আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে — প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী।

mahmudnewaz939@gmail.com

শেয়ার করুন