প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গাটি থেকে শিক্ষার্থীদের অধিকারের দাবী ওঠে, যেখানে তৈরি হয় নেতৃত্ব, দেশের জাতীয় ও রাজনৈতিক সংকটে যার অবদান ভুলে যাবার মতো নয়, সেটি ডাকসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন সংলগ্ন ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনের পাশে ভবনটির অবস্থান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ হচ্ছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা রেখে আসছে এই ছাত্র সংসদ। ৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন -- সবকিছুতেই রয়েছে ডাকসুর ভূমিকা।
স্বাধীনতা পরবর্তী স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন করতে সাহায্য করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। আর তাই একে বলা হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ।
প্রতিষ্ঠা
উপমহাদেশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ছিল সুসংগঠিত। সেটি গঠনের পেছনে ছিল আহমদ ফজলুর রহমানের ভূমিকা। তাঁকে উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগ আলীগড়ের মতো ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকায় গঠন করা যায় কি-না তা ভেবে দেখতে বলেন।
তিনি দেড় মাসের মধ্যে তাঁর হলের ছাত্র সংসদ গঠনের উদ্যোগ নেন এবং সেটার নাম দেন ‘মুসলিম হল ইউনিয়ন সোসাইটি’। পরে ‘সোসাইটি’ শব্দটি বাদ দেন। ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মুসলিম হল ইউনিয়নের অভিষেক হয়। পরবর্তীতে তিনটি হল ইউনিয়ন গঠিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয় কিছু সময় পর।
১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর। সেদিন কার্জন হলে শিক্ষকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ' নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ সেই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়। এরপর ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় এর খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ' গ্রহণ করা হয়।
জ্ঞানচর্চা, আত্মোন্নয়ন, সমাজসেবামূলক, খেলাধুলা ও শরীরচর্চা, বন্যা মহামারির মধ্যে ত্রাণকাজ পরিচালনা, প্রতি শনিবার হলগুলোতে সন্ধ্যায় আলোচনা সভা, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে আলেচনা - এসবই ছিল প্রথম দুই দশক ধরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল ইউনিয়নগুলোর কাজ।
ডাকসু সংগ্রহশালা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কার্যকর না থাকলেও ডাকসুর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন এবং এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত রয়েছে ডাকসু সংগ্রহশালায়। বর্তমানে যে ডাকসু ভবন এবং সংগ্রহ শালা রয়েছে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯৯১ সালের ২৬ শে মার্চ।
বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের স্থিরচিত্র সংরক্ষণ করা আছে এই সংগ্রহশালায়। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবেষ্টিত বিভিন্ন ছবি ছাড়াও বরেণ্য ব্যক্তিত্বের ছবি, লেখা, খবরের কাগজের সংগ্রহ রয়েছে।
এখানে আছে ৩৫ জন ভাষাসৈনিকের মুদ্রিত সাক্ষাৎকার, ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ২৯টি পোস্টার, ভাষাসৈনিকদের ১৫টি আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংবলিত ছবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র, ভাষাসৈনিক আবুল কাসেম ও খালেক নওয়াজ খানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, প্রচারপত্র, স্মারকলিপি ইত্যাদি রয়েছে এখানে।
২৮ বছর পর সর্বশেষ ১৯ এর ডাকসু নির্বাচন
১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ডাকসুর প্রথম নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে ভিপি মনোনীত ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে ডাকসুর প্রথম ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন এস এ বারী এটি এবং জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন জুলমত আলী খান।
২০১২ সালের ১১ই মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। কিন্তু, ২০১৭ সালে ২৫শে নভেম্বর থেকে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করেন সমাজকল্যাণ অনুষদের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফ।
২০১২ সালের দাখিলকৃত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। সাত মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচনের কোনো আয়োজন দৃশ্যমান হয়নি।
সর্বশেষ ২০১৮'র ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ঘোষণা দেয় যে ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরে, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ২৫ জন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করে। নির্বাচনে মোট ২৫ টি পদের মধ্যে ২৩টি পদেই নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ প্যানেলের নুরুল হক নুর ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জিএস পদে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ১০ হাজার ৪৮৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। এজিএস পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদ মনোনীত প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন নির্বাচিত হন। গত ২২ জুন ২০২০ সালে বর্তমান ছাত্র সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।
শিক্ষার্থীরা কী চায়?
১৯ এর নির্বাচনের পর প্রায় পাঁচ বছর হতে চললেও ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। কবে নাগাদ এই নির্বাচন হতে পারে এ বিষয়ে কেউ জানে না। ডাকসু নির্বাচনের দাবীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মাঝে মাঝেই রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও এতে কার্যত কোনো লাভ হয়নি।
তবে, শিক্ষার্থীদের দাবী ডাকসু নির্বাচন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রই পাল্টে যেত। তখন শুধু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত হতো না। গত নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ঐ নির্বাচনের ফলে ক্যাম্পাসের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে।
ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তানিশা ডাকসু নির্বাচনের দাবীতে মানববন্ধন করেছিলেন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। তার ভাষ্য, “ডাকসু না থাকায় আমাদের নিজেদের অধিকারের কথা আমরা তুলে ধরতে পারছি না। কারণ আমাদের কথা তুলে ধরার জন্য আমাদের কোন প্লাটফর্ম নেই। এই যে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরণের প্রকল্প হয় যেমন, মলচত্বরে যে প্রকল্প হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মতামত -- ডাকসু না থাকায় আমাদের মতামত উপর মহল পর্যন্ত যায় না।“
তানিশার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী ডাকসু কার্যকর থাকুক এটা চায়। তারা চায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হোক। তারা যেন তাদের দাবী আদায় করতে পারে। ডাকসু নির্বাচন আবার কবে হবে, কবে ছাত্রদের অধিকারের প্রশ্নে ডাকসু আবার সচল হবে তার খবর কারো কাছেই নেই।
shakibtahmid05@gmail