Bangla
4 days ago

দেজাভু: মস্তিষ্কের এক ধাঁধা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি Photo : মেডিকেল নিউজ টুডে

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

মনে করুন, আপনি একদিন হাঁটছেন গুলিস্তানের ফুটপাত ধরে। রোদটা মাথার ওপর জ্বলছে, কিন্তু হালকা বাতাস চলছে, তাই হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে না। হঠাৎ এক মোড়ে পৌঁছে আপনি থমকে দাঁড়ান। আপনার চোখ পড়ে একটি চা-স্টলে, পাশেই একটি সবুজ রঙের চেয়ার, আর তার পাশে এক বয়স্ক মানুষ ধূমপান করছেন। চারপাশে হকারদের চিৎকার, গাড়ির হর্ন, আর সেই চিরচেনা ঢাকার হৈ-হল্লা। হঠাৎ আপনার বুক ধক করে ওঠে। "এই জায়গাটা তো আগে দেখেছি," আপনি নিজেকে বলেন।

কিন্তু ভাবেন— কখন? কিভাবে? আপনি তো এই গলি দিয়ে কোনোদিন আসেননি। এর আশেপাশেও না। তবু সেই সবুজ চেয়ারের অবস্থান, সেই বৃদ্ধের মুখ, এমনকি হকারদের গলার স্বর— সব যেন আগেও একবার ঠিক এভাবেই ঘটেছিল। যেন জীবন কোনো পুরনো টেপ আবার চালিয়ে দিয়েছে।

এই অদ্ভুত অনুভূতির নামই দেজাভু (Déjà vu)।

এই ‘ভ্রম’ এর পেছনে আছে বিজ্ঞান

বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্কে স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়। যখন আপনি কিছু নতুন দেখেন বা অনুভব করেন, তখন তা স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি হিসেবে রেকর্ড হয়। পরে তা প্রয়োজন হলে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়।

কিন্তু দেজাভুর ক্ষেত্রে হয় কী- আপনি কোনো নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহণ করার সময়ই মস্তিষ্ক তা ভুলবশত সরাসরি দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে পাঠিয়ে দেয়— ফলে আপনার মনে হয়, "আমি এটা আগে কোথাও দেখেছি।" এটি অনেকটা এমন— কেউ হঠাৎ আপনার চোখ বন্ধ করে দেয়, কিন্তু আপনি এখনো সেই ঘরের ছবি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। অথচ আপনি জানেন, এই ঘর আগে কখনো দেখেননি।

মস্তিষ্কের কোন অংশ দায়ী?

গবেষকরা মনে করেন, টেম্পোরাল লোব, বিশেষ করে হিপ্পোক্যাম্পাস— স্মৃতি তৈরির মূল কারিগর। যখন এই অংশে অল্প সময়ের জন্য অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে, তখন মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয় এবং বলে ওঠে — "এই তো, এটা তো আমি চিনি!"

মজার ব্যাপার হলো, যারা টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি-তে ( মৃগীরোগ) ভোগেন, তাদের প্রায়ই দেজাভু-র মতো অনুভূতি হয়। যদিও বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই এটি নিছক একটি নিরীহ মানসিক ঘটনা।

কিছু কল্পনাপ্রবণ বিশ্বাস

বিজ্ঞানীরা যাই বলুন না কেন, কিছু মানুষের বিশ্বাস একেবারেই ভিন্ন। কারও মতে, দেজাভু হচ্ছে পূর্বজন্মের স্মৃতি— আগের জীবনে আপনি হয়তো এই জায়গায় ছিলেন। সেই স্মৃতিই ফিরে এসেছে এই জন্মে, আপনি মিলিয়ে ফেলছেন আপনার পূর্বজন্মের স্মৃতির সাথে! 

আবার কেউ বলেন, আপনি হয়তো স্বপ্নে এই পরিস্থিতি দেখেছেন, কিন্তু পরে তা ভুলে গেছেন। এখন যখন বাস্তবে মিল পাচ্ছেন, তখন মনে হচ্ছে — "এটা তো আগে হয়েছিল!" একজন সাহিত্যপ্রেমী হয়তো বলবেন, "জীবন হচ্ছে পৌনঃপুনিক প্রচার— একবারের না, অনেকবারের।"

বাস্তবের সঙ্গে মিল: কাকতালীয় নাকি স্মৃতির প্রতারণা?

দেখা গেছে, যারা বেশি মানসিক চাপে থাকেন বা ঘুমের ঘাটতি রয়েছে, তারা দেজাভু বেশি অনুভব করেন। আবার কিছু মানুষ যেসব জায়গায় অতীতে গেছেন, কিন্তু ভুলে গেছেন, সেসব জায়গায় গিয়ে দেজাভু অনুভব করেন— বাস্তব আর স্মৃতির মাঝের রেখাটি হয়ে পড়ে অস্পষ্ট। 

একজন ছাত্র বলেছিল, সে তার নতুন কলেজে গিয়ে প্রথম দিনেই অনুভব করে — "এই ক্লাসরুম তো আমি আগে দেখেছি।" পরে সে বুঝতে পারে, তার ছোটবেলার কোনো সিনেমার সেট এই ঘরের মতো ছিল।

 তাহলে কি আমরা দেজাভু থেকে কিছু শিখতে পারি?

অবশ্যই পারি। দেজাভু হলো মস্তিষ্কের একটি সংকেত— যা বলে, আপনার মন কতটা রহস্যময়! আমাদের স্মৃতি, চিন্তা, অনুভব — সবকিছু একটি সুতোয় গাঁথা, কিন্তু সেই সুতোর গিটগুলো কোথায় লুকিয়ে আছে, তা আমরা জানি না।

দেজাভু মনে করিয়ে দেয়, আমরা প্রতিদিন যা অনুভব করি, তা সবসময় বাস্তব নয়— অনেক সময় তা স্মৃতির বিভ্রান্তি। 

শেষ কথা

গল্পের শুরুতে যে চা-স্টল, সবুজ চেয়ার আর সেই বৃদ্ধ মানুষটির কথা হচ্ছিল, — হয়তো এগুলো সত্যিই আপনি আগে কোথাও দেখেননি। কিংবা হয়তো আপনার মস্তিষ্ক এগুলোর সাথে পুরনো কোনো অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পেয়েছে।

অথবা, কে জানে— হয়তো কোনো স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আপনি এই জায়গায় আগেই ঘুরে গিয়েছিলেন।

"আগে দেখেছি…" — এই একটুখানি অনুভবের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের মন ও মস্তিষ্কের চিরন্তন জাদুময়তা।

mahmudnewaz939@gmail.com

শেয়ার করুন