প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
আজ সৌদি আরবে ঈদ-উল-ফিতর পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ায় আগামীকাল শনিবার উদযাপিত হবে ঈদ। ঈদ-উল-ফিতরের দিন উদযাপনের প্রধান অনুষঙ্গ হলো ঈদের নামাজ। ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করা গেলেও, প্রায় সবাই-ই ঈদগাহ ময়দানে বড় জামাতের সাথে ঈদের নামাজ আদায় করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলাতেই আছে এক বা একাধিক ঈদগাহ ময়দান। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও জনসমাগম হওয়া ঈদগাহ ময়দানের তালিকা করলে তিনটি নাম আসবে সবার ওপরে। এগুলো হলো দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান ও ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দান।
গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দান
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বেশি মুসল্লি একসাথে ঈদের নামাজ পড়ার রেকর্ড দিনাজপুরে অবস্থিত এ ঈদগাহ ময়দানে। গোর-এ-শহীদ ময়দানটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দান। ২০২২ সালে এ ময়দানে ঈদুল ফিতরের নামাজে প্রায় ৬ লাখ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করেছেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে স্থায়ী কোন মিম্বার সেখানে নির্মাণ করা হয়নি। জেলা প্রশাসন স্থায়ী ঈদগাহ মিম্বার নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলো ২০১৫ সালে। ঈদগাহটির পরিকল্পনা ও অর্থায়ন করেছেন দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম।
গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দান। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গোর-এ শহীদ বড় ময়দানের আয়তন প্রায় ২২ একর। ২০১৭ সালে নির্মিত ৫২ গম্বুজের ঈদগাহ মিনার তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই ৫০ গম্বুজের দুই ধারে ৬০ ফুট করে ২টি মিনার, মাঝের দুটি মিনার ৫০ ফুট করে। ঈদগাহ মাঠের মিনারের প্রথম গম্বুজ অর্থাৎ মেহেরাবের (যেখানে ইমাম দাড়াবেন) উচ্চতা ৪৭ ফিট। এর সাথে রয়েছে আরও ৪৯টি গম্বুজ। এছাড়া ৫১৬ ফিট লম্বা ৩২টি আর্চ নির্মাণ করা হয়েছে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ঈদগাহ ময়দান হলো শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত এ ময়দানে প্রায় ২০০ বছর ধরে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এখানে একসঙ্গে তিন লক্ষাধিক মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করেন। এখানে নামাজ শুরুর আগে শটগানের ফাঁকা গুলির শব্দে সবাইকে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সঙ্কেত দেওয়া হয়। এ ময়দানের বিশাল জামাত গৌরবান্বিত ও ঐতিহ্যবাহী করেছে কিশোরগঞ্জকে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। ছবি: সংগৃহীত
কিশোরগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, প্রায় দুইশো বছর আগে ধর্ম প্রচারের জন্য দেশের বাইরে থেকে এ দেশে আসেন সৈয়দ আহাম্মদ (রহ.) নামের একজন ধর্মপ্রচারক। প্রথম এ মাঠে ঈদের নামাজের ইমামতি করেন তিনি। থাকতেন বীর ঈশা খাঁর বংশধর হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেওয়ানবাড়িতে। তখন থেকেই এ মাঠে নামাজ আদায়ের প্রচলন ঘটে।
১৯৫০ সালে দেওয়ান মান্নান দাদ খান সাড়ে তিন একর জমি এ মাঠের নামে ওয়াকফ করে দেন। ১৮২৮ সালে শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়বত খাঁ কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর এ ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে মাঠের জমির পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়।
স্থানীয়রা জানান যে, পূর্বপুরুষদের থেকে জানা যায় জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খান ঘোড়ার গাড়িতে সিংহাসন বসিয়ে বাহিনী নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে এ মাঠে নামাজ পড়তে আসতেন। এ ছাড়া ইটনা হাওরের জমিদারসহ বিভিন্ন এলাকার জমিদারেরা নৌকা সাজিয়ে এ ঈদগাহে নামাজ পড়তে আসতেন। জমিদারদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন বলে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোকজন জড়ো হতেন মাঠে। এভাবেই এ মাঠের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
এ ময়দানের নাম শোলাকিয়া হওয়ার পেছনেও রয়েছে ইতিহাস। ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামায়াতের আয়োজনে ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমেদ। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসল্লিদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে 'সোয়া লাখ' কথাটি ব্যবহার করেন। আরেক মতে, সেদিনের জামায়াতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়। ফলে এর নাম হয় 'সোয়া লাখি'। পরবর্তীতে উচ্চারণের বিবর্তনে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া_ সেখান থেকে শোলাকিয়া।
২০১৬ সালে শোলাকিয়ায় ঈদের জামায়াতে জঙ্গি হামলা করা হয়। তারপর থেকে সেখানে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে প্রশাসন। শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ পড়তে আসার জন্য দু’টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থাও থাকে।
জাতীয় ঈদগাহ
বাংলাদেশের জাতীয় ঈদগাহ বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈদের নামাজ পড়ার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ। এটি ঢাকা জেলার হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে অবস্থিত। জাতীয় ঈদগাহ হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার কতৃক নির্ধারিত একটি ঈদের নামাজের স্থান। এখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নানা বয়সী মানুষ নামাজ আদায় করে থাকেন।
জাতীয় ঈদগাহর গেট। ছবি: বিডিনিউজ২৪.কম
এখন যেখানে জাতীয় ঈদগাহ, সেই স্থানটি তখনও ছিল ঝোঁপজঙ্গল ঘেরা। তার পাশেই ছিল একটি বড় পুকুর। আশির দশকের শুরুতে সেই জঙ্গল কাটা শুরু হয়। ১৯৮৫ সালের দিকে পুকুরটি ভরাট করে এইচ এম এরশাদ সরকারের এক সিদ্ধান্তে স্থানটিকে জাতীয় ঈদগাহ মাঠ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ হাইকোর্টের অধীনে ঈদগাহটি পরিচালিত হলেও তার দেখভাল করে গণপূর্ত বিভাগ। ২০০০ সালে দুই ঈদেই ঈদগাহ প্রস্তুতের দায়িত্ব পায় ঢাকা সিটি করপোরেশন।
চারদিকে লোহার প্রাচীর দেওয়া বিশাল মাঠটিতে রয়েছে একটি মূল ফটকসহ কয়েকটি ফটক। কিবলার দিকে রয়েছে একটি মিহরাব। মিহরাবটি মূলত পাঁচটি মিনারে তৈরি। জাতীয় ঈদগাহে একটি জামাতে অন্তত এক লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। সেখানে একই জামাতে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থা। এখানে ২০ হাজার নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।
এবারও ঈদের জামায়াতের জন্য প্রস্তুত জাতীয় ঈদগাহ ময়দান। ৩৫ হাজার মুসল্লি একসাথে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারবে এ ময়দানে।
ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
faiyazahnaf678@gmail.com