Bangla
2 days ago

পরিবহন উন্নয়ন পরিকল্পনায় ভুল সংশোধনের উদ্যোগ

ঢাকার যানজট সমাধানে ৫৯ বিলিয়ন ডলারের নতুন পরিবহন পরিকল্পনা বাজেট

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং গত দুই দশকে যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার বর্তমান নাজুক অবস্থার সমাধানে একটি হালনাগাদ কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করা হচ্ছে। সংশোধিত এই পরিকল্পনায় আগামী ২০ বছরে প্রায় ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বাস রুট শৃঙ্খলায়ন এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এসটিপি সংশোধন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ২০ বছরে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ না থাকায় যানজট পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে, যার সমাধানেই এই নতুন পরিকল্পনা।

নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের এসটিপি-এর তুলনায় বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তা ১৮৬ শতাংশ এবং ২০০৫ সালের এসটিপি-এর তুলনায় ৭৩৭ শতাংশ বেড়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুল হক বলেন, গত কয়েক দশকে মূল পরিবহন ব্যবস্থার মৌলিক অবকাঠামো — বাস সেবা, ফুটপাত, সিগন্যাল ব্যবস্থা উন্নয়নের পরিবর্তে মূলত মূলধনী-নির্ভর প্রকল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।

২০১৫ সালের এসটিপি-তে (আরএসটিপি) পাঁচটি মেট্রো রেল (এমআরটি) লাইন, দুটি বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে এবং তিনটি রিং রোডসহ নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়।

২০০৫ সালের এসটিপি-তে তিনটি এমআরটি লাইন, তিনটি বিআরটি লাইন, এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নে ৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ছিল।

উল্লেখযোগ্য যে, উভয় এসটিপি-তে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বাস-ব্যবস্থার উন্নয়নকে তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার হিসেবে রাখা হলেও বাস্তবে এসব প্রকল্প কার্যকর হয়নি। বরং বিগত আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চ-ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি মেগাপ্রকল্পকেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে।

এসটিপি ২০২৫-এ নতুন কোনো গণপরিবহন ব্যবস্থা (ম্যাস ট্রানজিট) প্রস্তাব করা হয়নি। বরং আবারও বাস-নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া হয়েছে।

ইউআরএসটিপি প্রকল্পের পরিচালক রবিউল আলম জানান, এসটিপি ২০২৫-এর মূল ভিত্তি হিসেবে বাস-নেটওয়ার্ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকেই ধরা হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৫ এবং ২০১৫ সালের এসটিপি অনুযায়ী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বাস-ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক নেতা, ট্রাফিক পুলিশ এবং পরিবহন মালিকদের অদৃশ্য চক্রের কারণে ব্যর্থ হয়েছে।

এমআরটি ও বিআরটি প্রকল্পগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি এমআরটি লাইন চালু হয়েছে। নতুন যাত্রীবান্ধব বাস পরিষেবা চালু হয়নি। ১২ বছরেও শেষ হয়নি বিআরটি প্রকল্প।

বাস রুট শৃঙ্খলায়ন এবং রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্মসূচি পরিবহন মালিকদের সহযোগিতা না থাকায় কার্যকর হয়নি। সিগন্যালিং, ফুটপাত, রোড সাইনেজ এবং রাস্তা সংযোগ উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

ড. শামসুল হক বলেন, প্রতিবার এসটিপি হালনাগাদে যানজটের কথা বলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের পথ তৈরি করা হয়েছে — যা একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, “১৯৯০-এর দশক থেকে ডিইউটিএস ও এসটিপি প্রকল্পের সময় থেকেই এই ধারার সূচনা হয়েছে। অথচ আসল ফোকাস থাকা উচিত ছিল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বাস-নেটওয়ার্ক উন্নয়নে।”

এসটিপি ২০২৫ অনুযায়ী বাসের মাধ্যমে যাতায়াতের হার (মোডাল শেয়ার) ৯ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ঢাকার ৬০ শতাংশ যাত্রা বাসে সম্পন্ন হয়।

ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তিনটি এসটিপি-তে ছয়টি এমআরটি প্রস্তাব করা হলেও এর মধ্যে চারটির প্রকল্প ব্যয় ২০১৫ সালের ৯৪ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১ লাখ ৬৭ হাজার কোটি  টাকায় পৌঁছেছে।

এসটিপি ২০১৫-তে ৫২ কিলোমিটার এমআরটি ১ নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৫ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। তবে পরবর্তী সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে এর দৈর্ঘ্য কমিয়ে ৩১ কিলোমিটার করা হলেও ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়।

এমআরটি ৫ প্রকল্পও একইভাবে বিভক্ত হয়ে এমআরটি ৫ উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ হয়ে ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। এমআরটি ৫ উত্তর অংশের ২০ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এমআরটি ৫ দক্ষিণের ১০ কিলোমিটারের জন্য প্রস্তাবিত ব্যয় ৪৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।

এদিকে, নগরীর অভ্যন্তরীণ, মধ্যবর্তী ও বাইরের রিং রোড এবং এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পগুলোও পিছিয়ে রয়েছে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (ডিইই) প্রকল্পের ২৫ শতাংশ কাজ এখনও বাকি। এতে আরও দেড় বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ডিজাইন ও পরিকল্পনা সম্পন্ন হলেও ২০১৮ সালে এটি স্থগিত করা হয়। পরিবর্তে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ নগরীতে সাবওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব দেয়, যদিও ২০১৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে এর উল্লেখ ছিল না।

এছাড়া, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) জানিয়েছে, এসটিপি ২০২৫-এর খসড়ায় লাইট র‍্যাপিড ট্রানজিট (এলআরটি) প্রস্তাবও বাতিল করা হয়েছে।

নতুন পরিকল্পনায় বিদ্যমান এমআরটি লাইন সম্প্রসারণ এবং তাদের রুট হালনাগাদ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় গবেষণা এখনও শুরু হয়নি।

এসটিপি ২০২৫-এ বাস-নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, বাস রুট শৃঙ্খলায়ন এবং রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নগরীর পরিবহন ব্যবস্থার কার্যকর সমাধানের জন্য এসব পদক্ষেপকে অপরিহার্য বলে মনে করা হচ্ছে।

smunima@yahoo.com

 

শেয়ার করুন