প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
ময়মনসিংহ শহরের উল্লেখযোগ্য এক স্থাপনা ‘আলেকজান্ডার ক্যাসেল ’(Alexander Castle)। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এটি। বিখ্যাত এই ক্যাসেলটি নির্মাণ করেছিলেন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য।
তৎকালীন প্রায় ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় করে ১৮৭৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের পারে শহরের আদালত এলাকায় প্রায় ২৭ একর জমির বাগান বাড়িতে অট্টালিকাটি নির্মাণ করা হয়। এর নামকরণ নিয়ে দু রকমের কথা শোনা যায়।
কেউ বলেন, ব্রিটিশ শাসক সপ্তম এডওয়ার্ড ও তার স্ত্রী আলেকজান্দ্রারের নামানুসারে এ জায়গার নামকরণ করা হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, তৎকালীন কালেক্টর এন. এস. আলেকজান্দ্রারের নামানুসারে এর নামকরণ হয় আলেকজান্ডার ক্যাসেল। প্রাসাদ তৈরীতে লোহার ব্যবহার বেশি হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ‘লোহার কুঠি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
সুদূর চীন থেকে আসা কারিগর দিয়ে কাঠ ও লোহার অপূর্ব সমন্বয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়। সুন্দর শিল্পকর্ম ও নান্দনিকতায় পূর্ণ এই কুঠির প্রধান ফটকের সামনে দুটি মার্বেল পাথরের মূর্তি এবং চারদিকে কয়েকজন নারীর ভাস্কর্য রয়েছে।
গোটা বাড়িটাই একটা বিশাল স্তম্ভমূলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদীর বন্যার হাত থেকে বাড়িটাকে রক্ষা করার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। দ্বিতল ভবনের ছাদে অভ্র ও চুমকি ব্যবহার করে প্রাসাদের ভেতরে ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রাসাদের পেছনেই ছিল বিশালাকার পুকুর, ফুলের বাগান ও একটি কৃত্রিম হ্রদ।
উপর থেকে নেমে আসা ঢালু টিনের চালা দেখতে অনেকটা যেন ইউরোপীয় পুরনো ধাঁচের বাড়ির মতো। বহু ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে তবেই প্রবেশ পথের দেখা মেলে। নিচতলায় মোট চৌদ্দটি ঘর রয়েছে। একতলা আর দোতলার মাঝের অংশটাও চমৎকারভাবে কাঠের খড়খড়ি দিয়ে মোড়ানো।
পুরো ভবনটি এক সময় ঐতিহ্যবাহী হস্ত বা কারু শিল্পকর্মের অসাধারণ নিদর্শন ছিল। সময়ের ধারায় সেসব শিল্পকর্ম তাদের জৌলুশ হারালেও যেটুকু কাজ এখনো অবশিষ্ট আছে তাই বেড়াতে আসা দর্শকদের মুগ্ধ করে। আলেকজান্ডার ক্যাসেল মূলত মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে অট্টালিকাটিতে অনেক বরেণ্য ব্যক্তির পদধূলি পড়েছে। বহু গুণীজন ময়মনসিংহ সফরকালে এখানে এসে থেকেছেন। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহ সফরে এসে ভবনটিতে ৩-৪ দিন থেকেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একই বছর এখানে আসেন মহাত্মা গান্ধী। এখানে আরও এসেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, কামাল পাশা, লর্ড কার্জন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ওয়াজেদ আলী খান পন্নীসহ আরও অনেক গুণী ব্যক্তি।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালে আলেকজান্ডার ক্যাসেলকে ঘিরে নির্মিত হয় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। প্রথমদিকে প্রাসাদ ভবনটিকেই ক্লাস নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে কলেজের জন্য আরো ভবন নির্মিত হলে পর্যায়ক্রমে একে শিক্ষকদের থাকার স্থান এবং সর্বশেষ কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ক্যাসেলের একতলায় আটটি ঘরে প্রায় পঁচিশ হাজার বই রাখা আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ২০১৯ সালে ক্যাসেলটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
বর্তমানে এ সীমানার ভেতর রয়েছে শিশু কানন কিন্ডার গার্টেন, ময়মনসিংহ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ মোট সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। একটি সীমানা প্রাচীরের ভেতর সাতটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এই জমিটি এখনও খাসজমি হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় এখনও টিকে আছে। সংস্কারের অভাবে স্থাপনাটি এখন ধ্বংসের মুখে। খসে পড়ছে ক্যাসেলের পলেস্তারা, চুরি হয়ে যাচ্ছে লোহার তৈরি বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছে ফাটল। অযত্ম আর অবহেলায় ভেঙে গেছে মার্বেল পাথরের দুটি ভাস্কর্যের হাত। জমেছে ময়লা।
দূর্ঘটনা এড়াতে ফটকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ লিখে একটি সাইনবোর্ড টানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নেয়া হয়নি কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। বছরের পর বছর সংস্কারের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।