Bangla
2 days ago

ঈদ সিনেমার সেকাল-একাল

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

ঈদের দিন সকালে সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যাওয়া কিংবা কুরবানী ঈদে নামাজ পড়ে এসে কুরবানীর পর সেমাই-মিষ্টান্ন খেয়ে মাংস কাটাকাটি ও বণ্টনের তদারকি। এর ফাঁকেই রোজার ঈদে সকালে কিংবা কুরবানী ঈদে রাতের শো-তে অনেকেই দেখতে যেতেন সিনেমা। একটা সময়, ঈদে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল বিনোদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বন্ধু-বান্ধব মিলে দলবেঁধে কিংবা পরিবারের সবাই মিলে ভ্যানে বা রিকশায় চড়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিলো ঈদের এক অবধারিত কাজ। তখন সিনেপ্লেক্স এর কালচার গড়ে ওঠেনি।

সিনেমা হল মানেই তখন সিঙ্গেল স্ক্রিন। অল্প টাকা টিকেট। সেই টিকেটও অনেক সময় মিলতো না। কিংবা থাকলেও পাওয়া যেত না। সস্তার টিকেট কয়েকগুণ চড়া দামে বিক্রি হতো ব্ল্যাকে৷

সেই টিকেট পাওয়া নিয়ে মারামারি, ধস্তাধস্তি, হল ভাংচুরের মতো ঘটনাও ঘটতো দেদার। এতে খানিকটা বোঝা যায়, আমাদের দেশে তখন ঈদের সিনেমার কদর কতটা ছিলো, মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিনেমা দেখা।

সত্তর থেকে নব্বই দশকে আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার ছিলো জমজমাট। ঈদে মুক্তি পেত পাঁচ-ছয়টি করে সিনেমা৷ মূলত সামাজিক, রোমান্টিক ধাঁচের সিনেমাই বেশি হতো তখন, ছিল কমেডি সিনেমাও। তারপর একসময় অ্যাকশন সিনেমার কদর বাড়ল। রোমান্টিক-ড্রামা-অ্যাকশনের সমন্বয়েও হতে থাকল সিনেমা।

সে সময়ে আমাদের সিনে স্টারের অভাব নেই৷ রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, জাফর ইকবাল হয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল, জসিম; তারপর নাঈম, সালমান শাহ, মান্না, রিয়াজ প্রমুখ। কবরী, ববিতা, শাবানা, চম্পা, মৌসুমী, শাবনূর, পপি- সবারই কমবেশি ভক্ত-অনুরাগী ছিলেন।

তখন সারাবছরই সিনেমা মুক্তি পেত, দর্শক ছিল।

তবে ঈদের সময় সেই আমেজ আরও অনেক বেড়ে যেত। ঈদের সিনেমা দিয়ে বিভিন্ন তারকাদের অভিষেকও হয়েছে। যেমন- ১৯৮৬ সালের কুরবানীর ঈদে শহীদুল ইসলাম খোকনের 'লড়াকু' সিনেমাটি দিয়ে অভিষেক হয় চিত্রনায়ক রুবেলের। বাংলাদেশে আধুনিক মার্শাল আর্টভিত্তিক অ্যাকশনের সূচনা হয় এই সিনেমা দিয়েই।

১৯৯৩ সালে বলিউড সিনেমার রিমেক 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' দিয়ে অভিষেক হয় সালমান শাহ ও মৌসুমীর। ১৯৯৭ সালে পপির অভিষেক সিনেমা 'কুলি'-ও ছিলো ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা।

আবার ঈদের সিনেমা কারও কারও ক্যারিয়ারের জন্যও হয়ে এসেছে আশীর্বাদ। মান্নার ক্যারিয়ারের আলোচিত সিনেমা 'দাঙ্গা' ১৯৯২ সালের ঈদে মুক্তি পায়। কাজী হায়াৎ পরিচালিত এই সিনেমাটি তাকে দর্শকদের মাঝে আলাদা পরিচিত দেয়। তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হিট সিনেমা 'আম্মাজান' ১৯৯৯ এর ঈদে মুক্তি পায়।

তবে ২০০০ সালের পরে ক্রমাগত নিম্নমানের বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ দর্শকদের সিনেমা হল বিমুখ করে তোলে। এর ফলে সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে থাকে, অনেক দর্শকই প্রেক্ষাগৃহমুখী হওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে ঈদের সিনেমা তার আবেদন হারাতে থাকে। মাঝে মাঝে একটু সাড়া পেলেও সেটা স্থায়ী হচ্ছিল না।

তবে গত কয়েকবছর ধরে আবার ঈদকে কেন্দ্র করে দর্শকদের ভেতর সিনেমা দেখার আগ্রহ বৃদ্ধির ব্যাপারটি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হাওয়া, পরান, শান কিংবা ২০২৩ এর ইন্ড্রাস্ট্রি হিট 'প্রিয়তমা', 'সুড়ঙ্গ' এর মতো সিনেমাগুলো মানুষকে আবার হলমুখী করেছে। ২০২৪ এও যেমন 'দেয়ালের দেশ', 'কাজলরেখা'-র মতো হৃদয়গ্রাহী কাহিনীর ছবি এসেছে কিংবা আরেক ইন্ড্রাস্ট্রি হিট 'তুফান' ঈদের সিনেমা বাজার কাঁপিয়ে দিয়েছে।

২০২৫ সালের ঈদ-উল-ফিতর এক্ষেত্রে নতুন ও অনন্য এক মাত্রা যোগ করে। এই ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত 'বরবাদ', 'দাগী', 'জংলী', 'চক্কর' সিনেমাগুলো দেখতে দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে।

তবে বর্তমানে আর সারা দেশে সিনেমা হল নেই। অল্পকিছু সিঙ্গেল স্ক্রিন হল ছাড়া বাকি সবই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দেশে সচল সিনেমা হল রয়েছে মাত্র ৬২ টি৷ তবে ঈদের সময় আরও কিছু হল সাময়িকভাবে চালু করা হয়।

বর্তমানে সিনেমা হলের ব্যবসা সিনেপ্লেক্সকেন্দ্রিক। সেখানে চড়া দামে টিকেট বিক্রি হচ্ছে, সফট ড্রিংকস-পপকর্ন হাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বসে দর্শক উপভোগ করছেন সিনেমা। মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমায় যুক্ত হচ্ছে ভালো গল্পও। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির, বিশেষত তরুণদের হলমুখী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

তবে এ সময়ের বাণিজ্যিকভাবে বেশি সফল সিনেমাগুলো হয়ে পড়েছে সহিংসতা নির্ভর। রোমান্টিক, সামাজিক, ফোক কিংবা কমেডি-র মতো জঁরাগুলোতে কাজ আগের চেয়ে কম৷

সে জায়গাটি নিয়েছে হিন্দি সিনেমা 'এনিমেল' এর অনুসরণে বা সেই ধাঁচে নির্মিত সিনেমা; যেমন- তুফান কিংবা বরবাদ।

এবারের ঈদে যেসব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, তার ভেতর 'তান্ডব', 'ইনসাফ'- সিনেমাগুলোতেও এই ভায়োলেন্সের প্রাধান্য রয়েছে। তবে সিনেমাগুলোতে ভালো গল্প রয়েছে বলেও জানাচ্ছেন কলাকুশলীরা। এর বাইরে আছে 'উৎসব', 'নীলচক্র', 'এশা মার্ডার' এর মতো সিনেমাগুলোও। 'উৎসব'-এর মাধ্যমে বহুদিন পর ঈদে কোনো কমেডি ফ্যামিলি ড্রামা দেখতে পাবেন দর্শক। 'নীলচক্র' থ্রিলারধর্মী ও 'এশা মার্ডার' রহস্যকাহিনী। সেদিক থেকে বলা যায়, এবারের ঈদে দর্শকেরা ভিন্ন স্বাদের কয়েকটি সিনেমা দেখতে পাবেন।

বাংলা সিনেমার দর্শক থাকুক, ঈদে সিনেমা দেখার কালচার স্থায়ী হোক, সিনেপ্লেক্সের পাশাপাশি সিঙ্গেল স্ক্রিনের সংখ্যা বাড়ুক ও এসব হলের পরিবেশগত উন্নতি হোক, বাংলা সিনেমা তার সোনালী দিন ফিরে পাক- সার্বিকভাবে এটাই প্রত্যাশা৷

mahmudnewaz939@gmail.com

শেয়ার করুন