প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
বর্তমান বিশ্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংখ্যা প্রায় দুইশটিরও বেশি। ভূ-প্রকৃতি কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অনুযায়ী প্রত্যেক দেশই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এর মধ্যে কিছু দেশ আছে যেগুলো তাদের নিজস্ব জীবন-ধারা, শিক্ষা, এবং সংস্কৃতির জন্য শুধু সেই দেশের মানুষের কাছেই নয়, বিশ্ব দরবারেও পেয়েছে গ্রহণযোগ্যতা।
জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, টানা সপ্তমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলো ফিনল্যান্ড। এই দেশটির নাম শুনলেই আমাদের মনে ভেসে আসে তুষারে ঢাকা তীব্র হিমশীতল একটি দেশের কথা যেখানে কিনা বছরের প্রায় ছয় মাস টানা সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না।
নিশ্চয়ই ভাবছেন যেই দেশ প্রাকৃতিকভাবে এতটা বৈরী আবহাওয়ার অধিকারী, সেই দেশ কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হতে পারে? ভাবতে অবাক লাগলেও এটিই সত্যি।
ফিনল্যান্ডের আবহাওয়া প্রাকৃতিকভাবে কিছুটা শত্রুভাবাপন্ন মনে হলেও সেই দেশের মানুষজন কিন্তু নিজেদের দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে এর সঙ্গে। স্বভাবগতভাবেই কঠোর পরিশ্রমী ফিনল্যান্ডের মানুষ। সময়ের সঠিক ব্যবহারের প্রতি তারা বেশ যত্নশীল। আর তাই তো বৈরী আবহাওয়াকে পাশ কাটিয়ে তারা ঠিকই নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে কঠোর পরিশ্রম আর সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমে।
এতে করে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে বেশ উৎফুল্ল থাকতে দেখা যায় ফিনল্যান্ডবাসীদের যা তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জাতি হিসেবে পরিচয় এনে দিয়েছে।
কোনো একটি দেশের মানুষ কতটা সুখী সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই দেশের মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ভাষায়, "বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে, সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।" বাস্তবেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়াকে সকল সুখের মূল হিসেবে ধরা হয়।
আবার স্বাস্থ্যকে সম্পদের সঙ্গে তুলনা করার বিষয়টিও প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। আর কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ধাপগুলো বেশ সাফল্যের সাথেই অতিক্রম করতে পারে ইউরোপের এই দেশ।
সাইক্লিং, কায়াকিং, এবং জগিংয়ে খুব পারদর্শী ফিনল্যান্ডবাসী। আবহাওয়া যত প্রতিকূলই হোক না কেন এসব কাজ থেকে তারা কখনো নিজেদের বিরত রাখে না। ফলে বেশ আমোদে জাতি হিসেবে পরিচিত ফিনিশরা। আবার সাইক্লিংয়ে অভ্যস্ততার কারণে কার্বন নিঃসৃত গাড়ি ব্যবহারের উপর চাপ কমে যা পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।
ফিনল্যান্ডের সরকার তার দেশের নাগরিকদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠায় সবসময় তৎপর থাকে। সেই দেশে সকল নাগরিক যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা পায় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
ফিনল্যান্ডে ধনী ও দরিদ্র্যের মধ্যকার বৈষম্য নেই বললেই চলে। ফলে, মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্থ থাকার প্রবণতা কম দেখা যায় দেশটিতে। এছাড়া প্রায় সকল নাগরিকই সেই দেশে মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়ে থাকে।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে বাসস্থান একটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো বহু মানুষ গৃহহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। তবে এ চিত্র ফিনল্যান্ডে দেখা যায় না। কারণ, ফিনল্যান্ডে সরকার কর্তৃক সেই দেশের সকল নাগরিকের জন্য আবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।
ফিনল্যান্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সেই দেশের জনগণ একে অপরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও তারা বেশ বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে, ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এছাড়া যুদ্ধ কিংবা সংঘাত থেকেও সর্বদা নিজেদের বিরত রাখার চেষ্টা করে ফিনল্যান্ড যা দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা এবং সামাজিক নিরাপত্তার বিষটিতেও বেশ গুরুত্ব দেয় ফিনিশ সরকার। আইনের সঠিক বাস্তবায়নের ফলে সেই দেশে অপরাধ প্রবণতা খুবই কম যা ফিনল্যান্ডের অধিবাসীদের নিরাপদে জীবন-যাপন করতে সাহায্য করে।
ফিনল্যান্ডের মানুষ কখনো আড়ম্বরপূর্ণভাবে নিজেদের তুলে ধরতে পছন্দ করে না। সাদামাটা জীবনযাপনেই তারা অভ্যস্ত। আর তাই ফিনল্যান্ডের রাস্তায় অন্যান্য উন্নত দেশের মতো খুব বেশি বিলাসবহুল গাড়ি দেখা যায় না।
এমনকি সেদেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরাও উন্নত ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহারের চেয়ে সাদামাটা গাড়ি ব্যবহারের উপর জোর দেয়। আর অল্পতে তৃপ্ত থাকার অভ্যাস ফিনল্যান্ডবাসীকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে সাহায্য করেছে।
পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ফিনল্যান্ড। দেশটি তার নয়নাভিরাম রূপের জন্য পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়৷ এছাড়া দেশটির মানুষ পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে খুবই সচেতন। আর তাই সেখানে দূষণের মাত্রা কম হওয়াতে ফিনল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য দেশ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। আর এসব কারণেই ফিনল্যান্ডকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।