গান-কবিতা থেকে শুরু করে গ্রাম-বাংলার উৎসব-আমেজ: নবান্নে মেতেছে বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে এখন চলছে উৎসবের আমেজ। নতুন ধানের সোনালী আভায় ছেয়ে গেছে চারদিক। অগ্রহায়নের শুরু থেকেই পাকা ধান ঘরে আসার খুশিতে বাংলার প্রতিটি ঘরেই বিরাজ করে এক অন্যরকম অনুভূতি। আর তাই তো যুগ যুগ ধরে এই সময়টিতে গ্রামের মানুষ মেতে ওঠে নবান্ন উৎসবে।
ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে কার্তিক এবং অগ্রহায়ন- এই দুই মাস মিলে হয় হেমন্তকাল। এদেশের প্রতিটি ঋতুই নিজস্ব স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ। শরতের রোদ-বৃষ্টির খেলা শেষে প্রকৃতি যখন নতুনত্ব খুঁজে, ঠিক তখনই হালকা শীতের আভা নিয়ে হাজির হয় হেমন্তকাল।
মাঠে কৃষকের পাকা ধানের সোনালী রঙ হেমন্তের সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এসময় নতুন ধান কাটা এবং তা ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে সারা বছরের জন্য অন্নের ব্যবস্থা করে নেয় গ্রামীণ মানুষ।
ঐতিহ্যগতভাবেই এদেশের মানুষকে বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙালি। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে একদিকে যেমন প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, অন্যদিকে নদীর অববাহিকায় অবস্থিত বলে এটি ধান চাষের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর তাই তো আমন মৌসুমে উৎপন্ন ধান প্রায় সারা বছরের খাবারের খোরাক মেটায় গ্রামাঞ্চলের মানুষের।
বিশেষ করে কার্তিকে যখন ঘরের ফসল প্রায় শেষের দিকে থাকে সেসময় অগ্রহায়নের নতুন ধান একদিকে যেমন অন্নের যোগান দেয়, অন্যদিকে নতুন ফসলের খুশিতে কিষাণ-কিষাণীর মনও হয়ে ওঠে আনন্দে উদ্বেলিত। শুধু অন্নের যোগানই নয়,নতুন ধানের চাল দিয়ে নানাবিধ পিঠা তৈরির ধুম পড়ে এসময় গ্রামের বাড়িতে। পিঠা-পায়েশের সুগন্ধে চারপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে তখন।
এসময় আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে দাওয়াতের হিড়িক পড়ে। বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে কন্যারা। নতুন ধানের ভাত এবং পিঠা-পায়েশ শুধু নিজেরাই নয়, বরং পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্নীয়-স্বজনকে নিয়ে খেতে পছন্দ করে গ্রাম-বাংলার মানুষজন। সব মিলিয়ে সর্বত্র এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করে যা এদেশের মানুষের কাছে নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত।
অগ্রহায়ণে ধানের খেতে ফসল কাটার সময় এক ধরনের আমেজ লক্ষ করা যায় কৃষকদের মাঝে। ধান কাটার সময় কৃষকের গানে উৎসবের আমেজ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। চিরায়ত বাংলার লোকগীতিগুলো এসময় কৃষকের কণ্ঠে নতুন করে যেন প্রাণ ফিরে পায়।
বাঙালি বরাবরই উৎসবপ্রিয় জাতি। যেকোনো আনন্দ উৎসবে পরিবার-পরিজন নিয়ে মেতে ওঠা এই জনপদে আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। আর সেই উৎসবটি যদি হয় নতুন ফসল আগমন উপলক্ষ্যে তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
এসময় অনেকে শহরের যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ছুটে আসে গ্রামের উদার প্রকৃতির কাছে। শহরের জীবনে যেখানে একে অপরের সাথে দেখা হওয়াই ভাড়, সেখানে এই সময় গ্রামের মানুষ পরম মমতায় একে অপরকে আরো আপন করে নেয়।
পাশাপাশি গ্রামের নতুন ধানের চালে প্রকৃতির যে পরম মমতা মিশে থাকে তা যেন স্বাদে ও গন্ধে অনন্য। এই স্বাদ পেতে হলে গ্রামের পথে পা বাড়ানোটা যেন অবশ্যম্ভাবী। আর তাই তো সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ শত ব্যস্ততার মাঝেও ঠিকই সময় বের করে ছুটে যায় শেকড়ের কাছে।
শুধু ব্যক্তি কিংবা সমাজ জীবনেই নয়, সাহিত্যেও সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে বাঙালির নবান্ন উৎসব। এমনকি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- "ওমা অঘ্রাণে তো ভরা ক্ষেতে কি দেখেছি, আমি কি দেখেছি মধুর হাসি"
এছাড়া বিভিন্ন গীতিকাব্যেও সাহিত্যিকরা নবান্ন উৎসবের কথা তুলে ধরেছেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য, পল্লিকবি জসীম উদ্দীন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত কবিদের কবিতায়ও ফুটে ওঠেছে নবান্নের কথা। এছাড়া বিজন ভট্টাচার্য কর্তৃক নির্মিত 'নবান্ন' নাটকটিও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তবে প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও নবান্ন এসেছে ঠিকই, কিন্তু উৎসবের আমেজ এই বছর যেন কিছুটা ম্লান। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভয়াবহ বন্যার ফলে ফসলি জমিসহ অনেক পরিবার তাদের বসতবাড়ি হারিয়েছে। আর তাই তো সেসব জেলাগুলোতে এই বছর হচ্ছে না নবান্ন উৎসব। ফসলি জমি যেখানে নতুন ধানের সোনালী আভায় মুখরিত হয়ে থাকার কথা, সেখানে এখন কেবলই শূন্যতা আর হাহাকার।
বন্যায় বিপর্যস্ত জেলাগুলো এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এছাড়া অনেক পরিবার এখনো তাদের বসতবাড়িটুকু পর্যন্ত পুরোপুরি ঠিক করে উঠতে পারেনি। এমতাবস্থায় সেসব জেলাগুলোতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। তবে সকল বিপর্যয় কাটিয়ে আগামীতে আবারও নবান্ন উৎসবে পুরো দেশ মুখরিত হয়ে উঠবে এমনটাই এখন সকলের প্রত্যাশা।