গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ি: বৃটিশ শাসন আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করা এক স্থাপত্য
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ি। বেশিরভাগ জমিদার বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও আঠারো শতকের গ্রিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত এই জমিদার বাড়িটি অক্ষত আছে ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে।
গাংগাটিয়া জমিদার বাড়িটি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বাড়িটির নাম গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ি হলেও বর্তমানে বসবাসরত জমিদার বংশধর মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর ডাকনামের সাথে মিলিয়ে ‘মানব বাবুর বাড়ি’ নামেই সমধিক পরিচিত।
মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর বংশধরেরা ইংরেজ শাসনামলে এখানে এসে জমিদারি শুরু করেন। তাদের আদি নিবাস ভারতের কাইন্নকব্জিতে। জমিদার দীননাথ চক্রবর্তী ইংরেজ আমলে হোসেনশাহী পরগনার কিছু অংশ কিনে নেন এবং জমিদারি শুরু করেন। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায়, অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী প্রথম আঠারো বাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরানীর কাছ থেকে দুই আনা অংশ কিনে নেন এবং এই বাড়িটি জমিদারীর আওতায় আনেন।
তাদের জমিদারিকালে এই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, সাহিত্য ও জীবনযাত্রায় উন্নতি ঘটে বলে জানা যায়। জমিদারি প্রথা শেষ হয়েছে কবেই, বেশিরভাগ জমিদার বংশধররা ভারতে চলে গেছেন। তবে মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী (মানব বাবু) রয়ে গেছে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি আর এখানকার মানুষের মায়ায়। এখানেই আমৃত্যু থাকতে চান তিনি।
জমিদার বাড়িটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরো বাড়িটিই রয়েছে অবিকৃত। প্রাচীর ঘেরা সুবিশাল এলাকাটি সবুজে ভরা, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার বাড়িটি। রয়েছে অনেকগুলো প্রবেশদ্বার সহ মুল ফটক। ছোট ছোট প্রবেশদ্বার গুলোতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা আছে “স্বাগতম এবং মুল ফটকে জমিদার শ্রীধর চক্রবর্তীর নামানুসারে খোদাই করে লেখা আছে ‘শ্রীধর’।
বাড়ির সামনে রয়েছে সুবিশাল পুকুর। বাড়ির ভেতরে আছে কাছারিঘর, নহবতখানা সহ অনেক গুলো বিশ্রাম কক্ষ এবং একটি শিবমন্দির যেটি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কাড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জমিদার বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। তবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বাড়িটির সন্ধান পায় এবং হামলা করে হত্যা করে মানব বাবুর পিতা ভূপতি চক্রবর্তীসহ পরিবারের আরো কয়েকজন সদস্যকে। তার স্মরণে সেখানে রয়েছে একটি সমাধি সৌধ।
ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন মানব বাবুর এই জমিদার বাড়িটি কিশোরগঞ্জ জেলা শহর থেকে নিকটে হওয়ায় প্রতিদিন বাড়িটি দেখতে ভিড় করেন দর্শনাথীরা।
গাংগাটিয়া জমিদার বাড়িতে মানব বাবু তার স্ত্রী ও বোন নিয়ে বসবাস করছেন। প্রতিদিন দেখতে আসা দর্শনার্থীদের সাথে তিনি দেখা করেন ও কুশল বিনিময় করেন। ৯১ বছরের বৃদ্ধ মানব বাবু তার সাধ্যমতো দর্শনার্থীদের সমাদর করার চেষ্টা করেন।
১৯৭৪ সালের উপজেলা চ্যায়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মানব বাবু। বয়সের ভারে কর্মস্পৃহা কমে গেলেও তার জনসেবা এখনো থেমে যায়নি। স্থানীয় মানুষের মুখে শোনা যায় তার সুনাম আর দানশীল মনোভাবের কথা।
একসময় শিল্প ও সাহিত্য চর্চার জন্য জমিদাররা পরিচিত ছিলেন। এখনো সেই ধারা বজায় রেখেছেন মানব বাবু। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই সংগীতপ্রিয় মানুষদের নিয়ে জমিদার বাড়িতে বসে গানের আসর। হারমোনিয়াম, তবলা আর বাশির সুরে সে সময় গ্রামীণ পরিবেশ ছেয়ে যায় এক অন্যরকম শান্তি আর সৌন্দর্য্যে। মানব বাবু নিজেও গান গেয়ে থাকেন এই আসরে।
গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ির নতুন আকর্ষণ আরো মানব বাবুর মাছের প্রকল্প। বাড়ির পাশেই অবস্থিত ফিশারিজে অনেক প্রজাতির মাছ চাষ করেন তিনি।
তাই কিশোরগঞ্জ বেড়াতে গেলে গাংগাটিয়া জমিদার বাড়িতে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন একবার।
nawshinmushtary38@gmail.com