প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই?”
এ গান শুনে ফেলে আসা বন্ধু, ফেলে আসা আড্ডার নস্টালজিয়ায় ভোগেন না– এমন বাংলাভাষী সঙ্গীতপ্রেমী কমই আছেন। কেউ হয়তো বর্তমানে বসে অদূর ভবিষ্যতকে দেখেন এ গানে, কেউবা অতীতের প্রতিচ্ছবি।
বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টর নচিকেতার ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ, তখন বাংলা গানে বেশ সুরটুর করছেন। এই সুপর্ণেরই নিরীহ এক ঠাট্টায় বাঙালি পায় মনে থেকে যাওয়া, মনে রেখে যাওয়া এই গানখানা। সালটা ১৯৮৩। একদিন গৌরীপ্রসন্নকে ডেকে তিনি বলেছিলেন, “কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখে যাচ্ছ? একটু অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়ে তো একটা গান লিখতে পারো।” প্রথমে অতটা আমলে না নিলেও, আড্ডাবাজির মধ্যে বসেই মজুমদার মশাই আওড়ে দিলেন গানের ক’টি বুলি। সুর ভাঁজতেও দেরি হলো সুপর্ণের। বলা যায়, আড্ডাচ্ছলেই এক আড্ডার গান জন্ম নিয়েছিল সেদিন।
ততদিনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে গীতিকারের শরীরে। আগের মতো উৎসাহ নিয়ে কিছু করতে পারেন না। অথচ এই গান তিনি সারারাত ধরে লিখলেন। দুদিন পর গানের কাজ শেষ করে নিয়ে গেলেন সুরকার– অর্থাৎ সুপর্ণকান্তি ঘোষের কাছে। সুপর্ণের পীড়াপীড়ি অবশ্য তাতেও থামলো না। একটা ভালো ক্লাইম্যাক্সের অভাব মনে হচ্ছিল তার কাছে। শেষটায় যেন বাড়তি ‘আরো কিছু’ চাইছিলেন। ধন্যবাদ জানাতেই হয় তার সেই আবদারি স্বভাবকে, নয়তো গৌরীপ্রসন্ন আবার কলম হাতে নিতেন না। হাওড়া স্টেশনে বসে সিগারেটের প্যাকেটে লিখতেন না এই ক’টি লাইনও–
“সেই সাতজন নেই আজ, টেবিলটা তবু আছে
সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি–
শুধু সেই সেদিনের মালী নেই।
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে
কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়–
কত জন এলো–গেলো, কতজনই আসবে,
কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।”
অনেকেই ছিল, আজ কেউ নেই। ঠিক যেমন গানে, তেমনি জীবনে। নেই মান্না দে, গৌরীপ্রসন্ন, সুপর্ণকান্তিরাও– যাদের কণ্ঠে, কলমে, উতসাহে উপহার পেয়েছিলাম এই গানটি। নিখিলেশ, মইদুল, সুজাতাদের গল্পটা অপূর্ণই থেকে যেত। গিয়েওছিল, যদি না গানটির দ্বিতীয় পর্ব উঠে আসতো। সেই প্রথম গানের স্কেলেই তৈরি, সুরের বৈচিত্র্যে আরো দু কাঠি এগিয়ে। কিন্তু প্রথমটির মতো খ্যাতি ভাগ্যে জোটেনি তার। জোটেনি বলেই হয়তো এখনো অপূর্ণ সব গল্পের ভার নিয়ে শ্রোতামন চষে বেড়ায় নিজেদের প্লেলিস্টে।
প্রথম গানের কুড়ি বছর পর জন্ম নেয়া দ্বিতীয় সেই গানটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘স্বপ্নের কফি হাউজ’। শমীন্দ্রনাথ চৌধুরী তার লেখনীর জোরে সেই চিরচেনা গল্পটা আরো এগিয়ে যান। নতুন সময়ের দাবিতে মারিয়ম, ডিসুজার মেয়ে, অমলের ছেলে ইত্যাদি নতুন নতুন চরিত্র যোগ করেন। কণ্ঠে থাকেন মান্না দে নিজেই। একই কণ্ঠ হবার ফলে গানের ধারাবাহিকতাটা যেন আরো ভালোভাবে ধরে রাখে। মনে হয় একটা চেনা গল্পের দ্বিতীয় পর্বটাই শোনা হচ্ছে, জানা হচ্ছে তাদের ভালো কিংবা খারাপ থাকাটা। তবে গানটি শ্রোতাদের কাছে অতটা পৌঁছুতে পারেনি। এ নিয়ে হতাশা বাসা বেঁধেছিল মান্না দে’র মনেও। বলেছিলেন, “বাঙালি তো জানতেই পারল না সেই গানের কথা।”
তবে আগের চেয়ে এখনকার যুগে যেকোনো কিছুই জানা সহজ। ইউটিউবে ঢুঁ মারলেই শুনে ফেলা যায় কফি হাউজের সেইসব চরিত্রের কথা, যাদের গল্পে জুড়ে গেছি কল্পনার আঁচড়। আমরা এখন চাইলেই জানতে পাই, অভিমানী অমলের রেখে যাওয়া কবিতাগুলো পাঠক পেয়েছে, পেয়েছে মানুষের স্বীকৃতি। জানি সম্পর্কের বিচ্ছেদ কিংবা কারো কারো সুখে থাকার আলাপ।
পুরনোদের মতো করেই নতুন প্রজন্মকে আপন করে নেয় কফি হাউজ। গানের শেষে কোনো একটা আশার বাণী ছুঁড়ে দিয়ে স্বপ্নের কফি হাউজ থেকে যায় কালের সাক্ষী হয়ে–
“দেওয়ালের রঙ আর আলোচনা পোস্টার
বদলে গিয়েছে সব এখানে।
তবুও প্রশ্ন নেই,
যে আসে বন্ধু সেই–
আড্ডা–তর্ক চলে সমানে।
সেই স্বপ্নের দিনগুলো বাতাসে উড়িয়ে ধুলো
হয়তো আসছে ফিরে আবার
অমলের ছেলেটার হাতে উঠে এসেছে–
ডিসুজার ফেলে যাওয়া সে গিটার।”
যারা স্মৃতিতে বাঁচতে ভালোবাসেন, বাংলা গান যাদের এখনো আবেগী করে, তাদের জন্য হলেও সময়ের ভাঁজে বেঁচে থাকুক সেই গানগুলো– কফি হাউজের।
অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
anindetamonti@gmail.com