প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
সম্প্রতি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল'। প্রায় প্রতি বছরই এ সময়টিতে বাংলাদেশের মানুষ এমন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্মুখীন হয় যেখানে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় 'সিডর' কিংবা 'আইলা'র কথা মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠে উপকূল বাসিন্দাদের মন।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়গুলোতে সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে উপকূলবাসীদের নিরাপত্তায় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এসময় গণমাধ্যমগুলোতেও প্রচারিত হয় বিশেষ সতর্কবার্তা।
ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসময় উপকূলবাসীকে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উৎসাহিত করা হয়। এছাড়া সাগরে চলাচলকারী মাছ ধরার নৌকা কিংবা ট্রলারগুলোকেও উপকূলে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়।
তবে অবাক করার বিষয় হলো জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় যেখানে কিনা সবাইকে সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়, ঠিক সেসময় উপকূলের কাছে অবস্থানরত বড় জাহাজগুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গভীর সমুদ্রে।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হলেও বস্তুত জাহাজ এবং বন্দরের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঝড়ের সময় সাগরের ঢেউ উপকূলের কাছে এসে আছড়ে পড়ে। এতে করে বড় জাহাজগুলোতে ঢেউয়ের ধাক্কা লাগার ফলে জাহাজগুলো উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিঘ্ন হতে পারে বন্দরের পণ্য ওঠানামাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া ঝড়ে কোনো বড় জাহাজ উপকূলে আটকে পড়লে তা সেখান থেকে সরানো বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ। এতে করে ঐ এলাকায় পলি মাটির অতিরিক্ত আস্তরণ পড়তে পারে যা নদীর নাব্যতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
সাধারণত সমুদ্র বন্দরের বহিঃনোঙরের গভীরতা প্রায় ১০ মিটারের মতো হয়ে থাকে। ঝড়ের সময় যখন বড় বড় ঢেউ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসে তখন স্বভাবিকভাবেই জাহাজগুলো কিছুটা উপরের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু যখন স্রোত চলে যায় তখন জাহাজগুলো পুনরায় নিচের দিকে নামে যার ফলে অনেক সময় জাহাজগুলো সাগরের তলদেশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এতে করে জাহাজের তলদেশ ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এসময় একটি জাহাজ অন্য জাহাজের সাথে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে।
অন্যদিকে গভীর সমুদ্রে পানির গভীরতা ২ হাজার মিটার কিংবা তারও বেশি থাকে। ফলে সেখানে এসব দূর্ঘটনা ঘটার আশংকাও থাকে কম। তাই গভীর সমুদ্রে অবস্থানকালে বড় জাহাজগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদে থাকে। বর্তমানে পণ্য পরিবাহী জাহাজগুলোতে দুইটি ইঞ্জিন থাকে। আর এই দুইটি ইঞ্জিন চালু রেখে একটি বিশেষ কৌশলে জাহাজগুলোকে চালিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখেন নাবিকরা। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলার ফলে জাহাজ পানিতে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুবই কম।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (ওএসপি) অনুযায়ী, কোনো এলাকায় ল্যান্ডলক কিংবা প্রাকৃতিকভাবে বেষ্টিত সুরক্ষিত নৌবন্দর না থাকলে ঝড়ের সময় বড় জাহাজগুলোকে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দিতে হয়।
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা সমুদ্র সৈকতে 'ক্রিস্টাল গোল্ড' নামক একটি বৃহদাকৃতির জাহাজ আটকে পড়ে। ফলে সেখানে প্রায় ৫০০ মিটার এলাকাজুড়ে পলি জমে যায় যা সেখানকার নাব্যতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তীতে ২০২১ সালে জাহাজটি কেটে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়।
অন্যদিকে ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুতে একটি বড় জাহাজের ধাক্কা লাগে। সেসময় জাহাজের ধাক্কায় সেতুটির মাঝখানের একটি অংশ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এতে করে সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মূলত এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো দেশে ঝড়ের সময় বড় জাহাজগুলোকে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।