
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :

মারভেলের আয়রনম্যান আমাদের কাছে নিছকই এক কাল্পনিক চরিত্র। সে রক্ত মাংসের কোনও মানুষ নয়, রক্ত মাংসের মানুষের পক্ষে যেন সম্ভবও নয় তার পর্যায়ে যাওয়া। কিন্তু বিলিয়নিয়ার, প্রকৌশলী, রেকর্ড গড়া পাইলট, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং শেষ জীবনে রহস্যময় একান্তবাস, হাওয়ার্ড হিউস ছিলেন এক জীবন্ত টনি স্টার্ক, যিনি বাস্তব জগতে আয়রনম্যানের প্রতিচ্ছবি, যিনি ছিলেন আয়রনম্যানের পেছনে প্রেরণা। হাওয়ার্ড হিউস ছিলেন একজন ধাঁধাময় মানুষ, যার জীবন ছিল বিলাসিতা, প্রতিভা, পাগলামি ও নিঃসঙ্গতার মিশ্রণ।
১৯০৫ সালে টেক্সাসের হিউস্টনে জন্ম নেন হাওয়ার্ড রবার্ড হিউস জুনিয়র। তার বাবা, হাওয়ার্ড হিউস সিনিয়র আবিষ্কার করেছিলেন তেল খনন করার এক বিশেষ যন্ত্র যা পরিবারটিকে অল্প সময়েই ধনী করে তোলে। কিন্তু তরুণ হাওয়ার্ড উত্তরাধিকারী সম্পদ দিয়ে নয়, বরঞ্চ নিজের কৃতিত্বে অমর হতে চেয়েছিলেন।
পিতামাতার অকালমৃত্যুর পর তিনি কিশোর বয়সেই বিশাল সম্পত্তির মালিক হন। তখন কলেজ ছেড়ে তিনি চলে যান হলিউডে। তার ঘোষণা ছিল, “আমি বিশ্বের সবচেয়ে দুর্দান্ত সিনেমা বানাবো।” এটি দম্ভ ছিল না, ভবিষ্যদ্বাণী ছিল।
১৯২০-এর দশকে হলিউড তখন সোনালী যুগে প্রবেশ করছে ঠিক তখনই হিউস হয়ে ওঠেন এক উচ্চাভিলাষী প্রযোজক, যিনি কেবল সিনেমা বানাতে চাননি, ইতিহাস বানাতে চেয়েছিলেন।
১৯৩০ সালে তার মুক্তি পাওয়া যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ছিল হেল’স এঞ্জেল। তিন বছর ধরে তৈরি হওয়া সিনেমাটির পেছনে খরচ হয় অভাবনীয় ৩.৮ মিলিয়ন ডলার। বাস্তব বিমানের ব্যবহারে আকাশযুদ্ধের দৃশ্যগুলো ছিল সে সময়ে অকল্পনীয়। হেল'স এঞ্জেলের পর স্কারফেস (১৯৩২) তাকে আবারও খ্যাতি এনে দেয়।
হলিউডের তারকাদের সঙ্গে প্রেম ও আলো ঝলমলে জীবন, সব মিলিয়ে হিউস হয়ে ওঠেন “বিলিয়নিয়ার প্লেবয়” এর বাস্তব প্রতিমূর্তি।
কিন্তু ক্যামেরার পেছনে তার চোখ ছিল আকাশের দিকে। বিমান চালানোই ছিল হিউসের প্রকৃত নেশা। ১৯৩০-এর দশকে তিনি গঠন করেন হিউস এয়ারক্রাফট কোম্পানি, যেখানে তৈরি হয়েছিল এমন সব বিমান যা ভেঙে দেয় তখনকার সব বিশ্বরেকর্ড।
১৯৩৫ সালে এইচ-১ রেসার দিয়ে তিনি ঘণ্টায় ৩৫২ মাইল গতিতে উড়েন, যা ছিল নতুন বিশ্বরেকর্ড। ১৯৩৮ সালে তিনি মাত্র ৯১ ঘণ্টায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন, যা তাকে এক জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করে তুলে। তার কোম্পানিতে উদ্ভাবনকৃত প্রযুক্তি পরবর্তীকালে সামরিক বিমানের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একজন প্রকৌশলী হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন দূরদর্শী, তেমনি একজন পাইলট হিসেবেও ছিলেন তিনি নির্ভীক। বহু দুর্ঘটনায় আহত হলেও তার বিমান উড়ানো থামেনি। তিনি বলেছিলেন, “করলে অসম্ভব কাজটাই করো, কারণ সবাই আমাকে বলেছে যে আমার ইচ্ছাগুলো ছিল নিছক অলীক কল্পনা।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিউস তৈরি করেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কাঠের বিমান, যার নাম দিয়েছিলেন তিনি এইচ-৪ হারকিউলিস। বিমানটি ছিল দৈত্যাকৃতির, বিমানের ডানার প্রস্থ ২১৮ ফুট, যা ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়।
কিন্তু বিমানের নির্মাণ পুরোপুরি শেষ হতে হতে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে অনেকেই একে হিউসের পাগলামি বলছিল। সমালোচকরা বলাবলি করছিল যে এই বিমানের পক্ষে উড়া সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সালে সমালোচকদের সামনে প্রমাণ করার জন্য তিনি নিজেই বিমানটি উড়িয়ে দেখান।
জীবনের শেষভাগে হিউসের প্রতিভা তার নিজেরই শত্রুতে পরিণত হয়। তার ছিল ভয়াবহ ওসিডি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার), হ্যালুসিনেশন এবং প্যারানয়া। তিনি নিজেকে বন্দী করে রাখতেন অন্ধকার রুমে। কেবল মাত্র দরজার নিচ দিয়ে নোটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন তার কর্মচারীদের সঙ্গে।
গুজব আছে যে তিনি একই সিনেমা শতবার দেখতেন, নখ ও চুল কাটতেন না, এবং তার খাদ্য ছিল শুধুমাত্র স্যুপ ও চকোলেট বার। ধনকুবের হয়েও তিনি হয়ে উঠেন বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ।
১৯৬৩ সালে যখন স্ট্যান লি ও ল্যারি লিবার তৈরি করলেন আয়রনম্যান, তারা এমন এক চরিত্র তৈরী করতে চাইলেন যে হবে আধুনিক প্রযুক্তির প্রতীক, কিন্তু মানবিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।
স্ট্যান লি পরবর্তীতে বলেছিলেন, “টনি স্টার্কের প্রেরণা ছিল হাওয়ার্ড হিউস। একজন উদ্ভাবক, অভিযাত্রী, বিলিয়নিয়ার, প্লেবয়, এবং সব শেষে এক পাগলাটে প্রতিভা।”
ঠিক টনি স্টার্কের মতো হিউসও ছিলেন এক ধনী উদ্ভাবক ও প্রকৌশলী। অত্যন্ত আকর্ষণীয় কিন্তু নিজের সাথেই নিজে দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন নিজের সৃষ্টি ও নীতির মধ্যে আটকে থাকা এক শোচনীয় আত্মা।
রবার্ট ডাউনি জুনিয়র নিজেও আয়রনম্যান চরিত্রে অভিনয়ের সময় হিউসের কথা ভেবে তার অঙ্গভঙ্গি ও কথার ভঙ্গি অনুসরণ করেছিলেন বলে জানান এক সাক্ষাৎকারে।
১৯৭৬ সালে, ৭০ বছর বয়সে হাওয়ার্ড হিউস মারা যান এক নিঃসঙ্গ, কৃশকায়, কিন্তু কিংবদন্তীতে পরিণত হয়ে। কিন্তু তার উত্তরাধিকার আজও জ্বলজ্বল করছে। হাওয়ার্ড হিউস মেডিক্যাল ইন্সটিটিউট এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। হিউস এয়ারক্রাফট কোম্পানি এখনো আধুনিক বিমান ও মহাকাশ প্রযুক্তির পথিকৃৎ।
তার জীবন কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত হয় মার্টিন স্করসেজির দ্যা এভিয়েটর (২০০৪), যেখানে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও হাওয়ার্ড হিউসের চরিত্রে অভিনয় করে অস্কার মনোনয়ন পান।
হাওয়ার্ড হিউস ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। তিনি ছিলেন মানুষের সীমাহীন স্বপ্নের প্রতীক কিন্তু একই সাথে সেই স্বপ্নের ধ্বংসের সতর্কতা। তিনি আকাশ জয় করেছিলেন, কিন্তু নিজের মনের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে পারেননি নিজেকে। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, প্রতিভা আর উন্মত্ততা কখনও কখনও একই পাখির দুটি ডানা। হাওয়ার্ড হিউস কেবল মাত্র আয়রনম্যানের অনুপ্রেরণা নন, তিনিই বাস্তব প্রমাণ যে: প্রতিভার আলো যত উজ্জ্বল, তার ছায়া ততই গভীর।

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.