Bangla
a year ago

ঢাকার বাঈজী: ঘুঙুর পায়ের ইতিকথা        

হীরামন্ডির মতো ঢাকার কোথায় থাকতেন বাঈজীরা?

ঢাকায় বাঈজীদের কর্মজীবন শুরু হয় সতেরো শতকের দিকে, তবে উনিশ শতকেই নাচ-গান-মেহফিলের মূল জোয়ারটা আসে
ঢাকায় বাঈজীদের কর্মজীবন শুরু হয় সতেরো শতকের দিকে, তবে উনিশ শতকেই নাচ-গান-মেহফিলের মূল জোয়ারটা আসে

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

বিখ্যাত বাঈজী খুরশিদ জান। তার একটি সুন্দর ফুলের মতো মেয়ে আছে। নাম গুলশান। কিন্তু গুলশানের বাবা কে, তা সে জানে না। কেউ জানে না। খুরশিদ জানের খুব ইচ্ছা, তার মেয়ে গুলশান গান-বাজনা শিখবে, ভালো নাচবে। তার তুলনীয় কেউ থাকবে না। কিন্তু গুলশানের এসব পছন্দ নয়।

‘মেহের নেগার’ সিনেমার শুরুতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে বাজতে থাকে এক বাঈজীর বংশ পরম্পরায় নিজের পেশাকে জিইয়ে রাখার ইচ্ছা। কথাগুলো শুনে যেন ভারতের সদ্য মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজ ‘হীরা মান্ডি’র আলমজেবের কথাই মনে পড়ে। ভিন্ন সময়, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলমজেব আর গুলশান, খুরশিদ জান ও মল্লিকাজান মিলেমিশে এক হয়ে যায়। হয়তো অধিকাংশ বাঈজীই তা-ই।

বর্তমান ইসলামপুর এলাকার একটি পুরোনো বাড়ি। ছবি: মো. ইমরান

এই সিনেমাটির কাহিনীপট নেয়া হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের ১৯১৯ সালের একটি গল্প থেকে। কবি নজরুল, রবি ঠাকুর– এই প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সমসাময়িক বাঈজীদের উল্লেখও পাওয়া যায় হাকিম হাবিবুর রহমানের রচনায়। বলা হয়, রেডিওতে মোস্তারী বাঈয়ের গান শুনে নাকি রেডিও অফিসে কবিগুরু ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এই দেবীকে কোন গন্ধর্বলোক থেকে নিয়ে এলে?”

নৃত্য ও সঙ্গীতকলা এখন সহাস্যে আমাদের বাড়ির আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে পারলেও একসময় অন্তঃপুরের নারীদের জন্য তা ছিল গর্হিত কাজ। আর পুরুষেরা বিনোদনের উদ্দেশ্যে যেতেন নাচনেওয়ালী-গানেওয়ালীদের কাছে, যাদের অন্যতম হচ্ছেন বাঈজীরা। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ‘বাঈ’ শব্দটি দ্বারা মূলত ধ্রুপদী নৃত্য-গীতে দক্ষ নারীদের বোঝানো হতো। ছোট থেকেই যারা ওস্তাদের কাছে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী জীবনে নাচ-গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতেন। সম্মানার্থে ‘জী’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে লোকে তাদেরকে বাঈজী বলতো।

বর্তমান জিন্দাবাহার লেন যেখানে এক সময় থাকতেন নামকরা বাইজী রাজলক্ষ্মী, ছবি: মো. ইমরান

পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে থাকতেন বাঈজীরা

পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার লেনের নামখানা এখনো ‘জিন্দা’ আছে তার আশপাশের প্রিন্টিং প্রেস, কাগজ কিংবা ব্যাগ তৈরি কারখানার বদৌলতে। কিন্তু একসময় যে এখানকার ভগ্নদশা বাড়িগুলোর নকশাদার গ্রিলের ফাঁকে উঁকি দিত কোনো রহস্যময়ী চোখ, চোখের ভ্রুকুটি– তা এ পথে এলে এখন আর বোঝার কোনো উপায় নেই। সময়ের আবরণ যেন ভালো করেই ঢেকে দিয়েছে ঢাকার বাঈজীবাড়ির ইতিহাস।

জিন্দাবাহার লেনের দেবী বালা কিংবা দেবী বাঈজীকে আনা হয়েছিল ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ এর জন্য। বিশ শতকের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত বাঈজী। নায়িকা লোলিতাও শোনা যায় ছিলেন বাদামতলীর নিষিদ্ধপল্লীরই বাসিন্দা। সহ-নায়িকাও তা-ই।

আসলে তখনকার দিনে অভিনয় কিংবা নৃত্য-সঙ্গীতে ‘ভদ্দরঘরের মেয়ে’দের আনাটা তো সম্ভব ছিল না, তাই শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে নারীদের প্রতিনিধি হয়ে এগিয়ে আসতে হতো বাঈজীদেরকেই। এমনকি শুদ্ধতাবাদের অন্যতম অনুষঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীতকেও জনপ্রিয় করার পেছনে নাকি রয়েছে বাঈজীদেরই কণ্ঠ, তারা নিজেদের মতো করে একটু সুর বদলে নিলেও রবি ঠাকুর অত কিছু মনে করতেন না।

ঢাকার সুপেয় পানির ব্যবস্থা থেকে শুরুকে মন্দির-মসজিদ নির্মানে দান করছেন বাঈজীরা

জিন্দাবাহারে আরো ছিলেন রাজলক্ষ্মী। সুর মহিমার চেয়ে তার নাম বেশি আলোকিত করে রেখেছে তার দানের সুনাম। ১৮৮৬ সালের দিকে একবার ভূমিকম্পে যখন এলাকার কালীমন্দির ভেঙে যায়, তিনি তা মেরামত করিয়ে দিয়েছিলেন।

দানের গর্বে ভরপুর আরেক বাঈজী ছিলেন আমিরজান। মুনতাসীর মামুনের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৭৪ সালে ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য যখন নবাব আবদুল গনি একটি বৈঠকের আয়োজন করেন, তাতে উপস্থিত ছিলেন রাজলক্ষ্মী ও আমিরজান– উভয়ে। অন্য সব বণিক-জমিদারদের এ আসরে বসে মাত্র দুজন এ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা করতে চেয়েছিলেন, আর তারা ছিলেন এই দুই বাঈজী।

ইসলামপুরের নবাব বাড়ির গেট। এই ইসলামপুর এলাকাতেও থাকতেন শহরের বিখ্যাত বাঈজী যারা নৃত্য পরিবেশন করতেন আহসান মঞ্জিলের রংমহলে। ছবি: মো. ইমরান

গঙ্গাজলির গল্প

ঢাকায় বাঈজীদের কর্মজীবন শুরু হয় সতেরো শতকের দিকে, তবে উনিশ শতকেই নাচ-গান-মেহফিলের মূল জোয়ারটা আসে। তখন তুঙ্গে রয়েছে নবাবদের আমল। আহসান মঞ্জিলের রং মহল, শাহবাগের ইশরত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে বাঈজীদের পরিবেশনা প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই রাঙিয়ে দিতো সময়টাকে।  চুড়িদার পাজামা-ওড়না আর পায়ে চিকন ঘুঙুর পরে বাঈজীরা মাতিয়ে রাখতেন নবাবদের আসর।

বলিউডের সিনেমায় বাঈজীদের নিয়ে সবসময়ই বেশ ভালো মাতামাতি দেখা যায়। শরৎচন্দ্রের দেবদাস অবলম্বনে সঞ্জয় লীলা বানশালি পরিচালিত একই নামের সিনেমায় একটি সংলাপে বলা হয়, “তওয়ায়েওফো কা শওহার নেহি হোতা।” অর্থাৎ, বাঈজীদের কোনো স্বামী হয় না।

তবে অন্তত ঢাকার বাঈজীদের ক্ষেত্রে এই কথাটা সত্যি ছিল না। তাদের অনেকেরই বৈবাহিক বন্ধনের কথা জানা যায়। লক্ষ্ণৌ থেকে আগত সুপনজান উনিশ শতকের শেষ সময়টাতে ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। ইতিহাস বলে, তিনি ছিলেন লক্ষ্ণৌ বিখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠন খানের নাতবৌ।

পাটুয়াটুলির একটি পুরোনো বাড়ি। হয়তো কোনো বাঈজী এখানেও থাকতেন। ছবি: মো. ইমরান

মোগল আমলে যখন লাহোরে বেড়ে উঠছিল হীরা মণ্ডীর মতো রমরমা বাঈজীবাড়ি, ঢাকাতেও তখন জন্ম নিচ্ছে গঙ্গাজলির মতো এলাকা। ইসলামপুর ও পাটুয়াটুলীর মোড় থেকে যে রাস্তাটি ওয়াইজঘাট নাম নিয়ে বুড়িগঙ্গার দিকে বয়ে গেছে, তার নাম ছিল গঙ্গাজলি। সূর্য অস্ত যাবার পর থেকেই সেখানকার আবহ নেচে উঠতো সেতারের ঝঙ্কারে, নুপূরের নাচনে। বর্তমান ইসলামপুর এখন কাপড়ের দোকান. রঙ-বেরঙের থ্রি-পিস ও বোরকা থেকে শুরু করে ছেলেদের শার্ট ও প্যান্ট পিস পাওয়া যায় সেখানে। আবার ঘড়ি ও চশমার বাজারো জমজমাট পাটুয়াটুলি এলাকায়। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা মিলবে শুড়কি মাটির দালান। নুয়ে পঢ়া ঝুরঝুরা বাকরখানির মতো এই সব দালানের অবস্তা বাঈজীদের ইতিহাসের মতোই; অযত্নে টিকে থাকা।

বর্তমানের বুড়িগঙ্গা ঘাট, ফরাশগঞ্জ। ছবি: মো. ইমরান

ভোরবেলা দল বেঁধে বাঈজীরা যেতেন বুড়িগঙ্গায় স্নান করতে। বলাই বাহুল্য, একালের গঙ্গাবুড়ি সেকালে যথেষ্ট যৌবনবতী ছিল, আবর্জনার ভারে সে তখনো এমন কালো হয়ে যায়নি। আর বাঈজীদের সেই স্নানে যাবার দৃশ্য আশেপাশের মানুষদের জন্য ছিল এক আগ্রহের বিষয়। কেননা বাঈজীদের কাছে তো আর কেউ যথেষ্ট বিত্ত-বৈভব না থাকলে যেতে পারতো না, তাই দূর থেকেই ওটুকু দৃষ্টিসুখের সুযোগ ছাড়তো কম লোকেই।

সেসময়ে ঢাকায় বাঈজীরা ছাড়াও আরেক ধরনের নাচনেওয়ালী-গানেওয়ালীদের দেখা মেলে, তবে তাদের পদমর্যাদা বাঈজীদের মতো এত উঁচু ছিল না। এই দলটিকে বলা হতো খেমটাওয়ালী। বাঈজীরা সাধারণত একা নাচতেন, এবং তাদের গান ও নাচে একটা ভারিক্কি ভাব বজায় থাকতো।

বাঈজী নাচের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল হাতের ভঙ্গিমায় আঁকা ছন্দ, মুখ, চোখ, নাক ও ঠোঁটের সূক্ষ্ম কম্পন। অপরদিকে খেমটা নাচ-গান ছিল হালকা, ফুরফুরে ও যৌন আবেদনে ভরপুর। অনেক খেমটাওয়ালীই আরো তালিম নিয়ে, দক্ষ হয়ে বাঈজীর মর্যাদা পেয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন দেবী বাঈজীও।

বাঈজীদের জীবনে অর্থ-বিত্তের অভাব ছিল না, তবে সম্মানের দিক দিয়ে তারা কখনো অন্দরমহলের নারীদের তকমা পেতে পারেননি। তবে আদতে বাঈজীদের সে ইচ্ছে ছিল কি না, তাও ভেবে দেখবার বিষয়। অন্দরমহলের নারীরা যেখানে নিষ্পেষিত-নিপীড়ির, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিলেন, সেখানে বাঈজীরা যেন আঙুলের তুড়িতে নাড়িয়ে দিতে পারতেন নবাবদের ভাগ্য, উল্টে-পাল্টে দিতে পারতেন সামনে রাখা দাবার চাল। আলতা-আবিরে মাখামাখি পোশাকে তারা আঁকতেন একেকটি জাঁকজমক সন্ধ্যার ছবি।

আচ্ছি বাঈজী ছিলেন নবাব আব্দুল গনির আসরের সবচেয়ে নামকরা বাঈজী। অনেক নতুন তার কাছে তালিমও নিয়েছেন। লেখক ও বিশেষজ্ঞ হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে, ঢাকায় আচ্ছি বাইয়ের মতো বড় নর্তকী আর কেউ আসেননি।

সংস্কৃতি চর্চায় বাঈজীরা, সাহিত্য নির্মাণেও রয়েছে বাঈজীদের ব্যাপক অবদান। কবিতা লেখা, কবিতা পাঠ– সেই কাব্যে সুর দিয়ে গান রচনা, গান গাওয়া, গানের সুরে নেচে আসর জমিয়ে রাখা; বহু বাঈজীর মধ্যেই ছিল এই বহুমাত্রিক প্রতিভার আকর। এমনকি অভিনয়শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবেও বাঈজীরা নাম কুড়িয়েছেন।

সূর্যাস্তের সুর

১৯৪০ সালের দিকে বাঈজীদের সময় ঢাকায় ফুরিয়ে আসে। আদতে বাঈজীদের ঠাটবাট সবই ছিল তাদের পৃষ্ঠপোষক, অর্থাৎ ধনীদের বদৌলতে। এদের মধ্যে কেউ ছিলেন নওয়াব, কেউ ছিলেন জমিদার। এসব প্রথাই যখন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হলো, তখন বাঈজীদের পেশাও যেন প্রাসঙ্গিকতা হারালো।

আর সময়ের সাথে মসলিনের স্বচ্ছ আঁবরোয়ার আঁচলে ঢাকা মুখগুলোও ক্রমশ অস্বচ্ছ হয়ে গেল। আশা করতে দোষ নেই, বাঈজীদের ভাগ্য হয়তো দাঁড়িয়েছে সুন্দর কোনো মোড়ে– যেখানে জানকী বাঈকে নবাবের রক্ষিতারূপে গুনতে হয় না শরীরে ছাপ্পান্নটি ক্ষতের দাগ, হতে হয় না ‘ছাপ্পান্ন ছুড়ি’।

anindetac@gmail.com

শেয়ার করুন