প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জনপদ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা। ঢাকা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে মুক্তাগাছার অবস্থান। পূর্বে এখানে আলাপশাহী, হোসেন শাহী ও মোমেনশাহী নামে ঈশা খাঁর তিনটি পরগনা ছিল। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর আলাপশাহী পরগনার দায়িত্ব পান (১৭২৭ ইং) শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। বংশের প্রথম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১১৩২ সালে মুক্তাগাছাকে আলাপশাহী পরগণার অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। দায়িত্ব পাওয়ার আগে এ অঞ্চলে কখনো আসেননি তিনি।
১৭৭৯ইং সালে শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামরাম পিতার জমিদারি আলাপশাহীতে ভ্রমণে আসেন। এ সময় তিনি আয়মান নদী দিয়ে বিনোদবাড়ি গ্রামে উপস্থিত হন। বিনোদবাড়িতে কয়েকজন গরীব মানুষের বসবাস ছিল। নতুন ভূস্বামী উপস্থিত হওয়ায় সাধ্যমত উপহার উপঢৌকন নিয়ে গ্রামবাসীরা তাকে দেখতে আসে। উপহার সামগ্রীর মধ্যে মুক্তারাম নামের জনৈক কর্মকারের একটি গাছা পিলসুজ সবচেয়ে মূল্যবান ও নির্মাণ শৈলিতে বেশ আকর্ষণীয় ছিল। রামরাম প্রজাদের সংবর্ধনায় অত্যন্ত খুশি হয়ে উক্ত ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মুক্তারামের নামের প্রথম অংশ ‘মুক্তা’ এবং তার দেওয়া ‘গাছা’ একত্রে করে বিনোদবাড়ির নাম বদলে রাখেন মুক্তাগাছা।
১৮ শতকে ভূমিকম্পে বাড়িটি ভেঙ্গে পড়লে লন্ডন আর ভারত থেকে সুদক্ষ কারিগর এনে ভূমিকম্প সহিষ্ণু করে পুনঃনির্মাণ করা হয় জমিদার বাড়িটি। ময়মনসিংহ থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে টাঙ্গাইল ও জামালপুর মহাসড়কের সংযোগস্থল থেকে ১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে জমিদার বাড়ির অবস্থান। মুক্তাগাছার তদানীন্তন জমিদার বৃটিশ সাম্রাজ্য কর্তৃক প্রথমে রাজা এবং পরে মহারাজা উপাধি পেয়েছিলেন বিধায় জমিদারের বাসভবন রাজবাড়ি হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলো।
জমিদারির অংশগুলো শাসন করতেন ১৬ জন আলাদা জমিদার। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের বংশধরদের প্রায় সবাই ভারতে চলে যায়, পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে তাদের প্রত্যকের নির্মিত জমিদার বাড়ি।
এখনো রাজবাড়ির ভেতরে আছে জমিদারের মায়ের ঘর, অতিথি ঘর ও সিন্দুক ঘর। এ সিন্দুক ঘরেই জমিদারের সোনা-দানা, টাকা-পয়সা সহ অন্যান্য মূল্যবান সব জিনিসপত্র রাখা হতো। রাজবাড়িতে সিন্দুকের ভগ্নাবশেষ দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। জমিদার তার স্ত্রীসহ থাকতেন দ্বিতল ধরনের একটি বাংলোতে।
জমিদার আচার্য চৌধুরী জ্ঞান চর্চা করতে পছন্দ করতেন। তার ব্যক্তিগত একটি লাইব্রেরি ছিল, যেটি ‘জিতেন্দ্র কিশোর গ্রন্থাগার’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বৃহৎ লাইব্রেরি ছিল এটি। বইয়ের সংগ্রহ ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। তালপাতায় লিখিত পুঁথি থেকে শুরু করে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার মতো বহু দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ ছিল এখানে। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে গেলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। পরবর্তীকালে বইগুলো ‘মুক্তাগাছা সংগ্রহ’ নামে বাংলা একাডেমিতে স্থানান্তরিত হয়।
জমিদারের ছোট ছেলে কুমার ভূপেন্দ্র কিশোর ছিলেন ভীষণ নাটক-প্রিয় একজন মানুষ। তার নামানুসারেই 'ভূপেন্দ্র রঙ্গ পীঠ’ নামে ঐতিহাসিক মঞ্চ তৈরি করা হয় রাজবাড়িতে। তৎকালীন সময়ে কলকাতার বাহিরে প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ছিল এটি। বর্তমানে মঞ্চটির কোনো অস্তিত্ব নেই বাড়িটিতে।
রাজবাড়ির শেষের দিকে ভেতরের অংশে আছে একটি ছোট পুকুর, বর্তমানে যেটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এর পরেই রাজবাড়ির সীমানা প্রাচীর। বাড়ির প্রবেশ মুখে আছে বিশালাকার একটি সিংহ দরজা। জমিদারদের বাড়ি গুলোতে (রাজবাড়ি ব্যাতিত) গড়ে তোলা হয়েছে শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প, সাব রেজিস্ট্রি অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নবারুণ বিদ্যা নিকেতন সহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। জমিদারদের কয়েকটি বাড়ি এখনো বেদখল হয়ে আছে যেখানে অবৈধভাবে বসবাস করছে অনেকে।
বিশাল আকারের পুকুর বিষ্ণু সাগর, প্রাচীন স্থাপনা যুগল মন্দির, চাঁন খাঁর মসজিদ, বিবির ঘর, ঘূর্ণায়মান নাট্য মঞ্চ, সাত ঘাটের পুকুর, জলটং, রসুলপুর বন ইত্যাদির মতো অসংখ্য দর্শনীয় স্পট রয়েছে রাজবাড়িতে।
প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন জমিদার বাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়। ক্যালেন্ডারে বহু বছর কেটে গেলেও, জমিদার বাড়ি তার আগের ঐশ্বর্য্য হারালেও, পর্যটকদের আনাগোনায় এখনো মুখর থাকে পুরনো বাড়িটি।
মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি যাবেন কিভাবে?
ময়মনসিংহ নেমে টাঙ্গাইলগামী বাসে করে ২০-৩০ টাকা ভাড়ায় খুব সহজেই মুক্তাগাছা চলে আসতে পারবেন। সিএনজি রিজার্ভ করে অথবা লোকাল সিএনজি করেও যাওয়া যায় রাজবাড়িতে। ময়মনসিংহ থেকে মুক্তাগাছার দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার । যেতে সময় লাগবে ৪০-৫০ মিনিট। মুক্তাগাছায় নেমে হেঁটে কিংবা রিক্সায় করে বাজারের ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে।