প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
“এই শহর জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকা রে” চিরকুট ব্যান্ডের এই গানের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন অনেকেই। তবে যে বিষয়টি নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, ঢাকায় জাদু থাকুক না থাকুক, অনেকগুলো জাদুঘর রয়েছে। ছুটির দিনে কিংবা কাজের ফাকে হুটহাট ঘুরে আসার জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে এই জাদুঘরগুলো।
জাতীয় জাদুঘর
১৯১২ সাল। লর্ড কারমাইকেল ঢাকা সফরে এলেন। ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য কিছু করতে চাইছেন। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা তাঁর কাছে একটি দাবি নিয়ে গেলেন, একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি। কারমাইকেলেরও মনে হলো জাদুঘর একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে বটে। ঢাকাবাসীর এ দাবির প্রেক্ষিতে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা জাদুঘর যা আজ জাতীয় জাদুঘর।
প্রায় সাড়ে আট একর পরিমাণ জমির ওপর গড়ে ওঠা এই জাদুঘরে নিদর্শনের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৮৬ হাজারে। চারতলাবিশিষ্ট ভবনে ৪৫টি গ্যালারিতে নিয়মিত প্রদর্শিত ৩০ হাজার নিদর্শন ছাড়াও বিশেষভাবে সংরক্ষিত রয়েছে কিছু নিদর্শন, যা বিশেষ সময়সূচী অনুসরণ করে গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়।
ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, শিল্পকলা, প্রাকৃতিক ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত নিদর্শনাদি জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে। প্রদর্শিত হয় কুষাণ, গুপ্ত, ময়নামতি স্বর্ণমুদ্রা এবং সুলতানী ও মুগল আমলের স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা , পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ ও প্রস্তর ভাস্কর্য, প্রাচীন স্থাপত্যিক নিদর্শনসমূহ, শিলালিপি ও তাম্রলিপি, মৃৎপাত্র, পান্ডুলিপি, ঐতিহাসিক দলিলপত্র, কৃতিসন্তানদের ব্যক্তিগত স্মৃতি নিদর্শন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও আলোকচিত্র, রুশিল্পকর্ম, কারুশিল্পকর্ম, ধাতব শিল্পকর্ম, চীনামাটির শিল্পকর্ম, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম, সূচিশিল্পকর্ম।
বৃহস্পতিবার এই জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচার একটি সাবেকি ভবন ভাড়া নিয়ে যথাযথ সংস্কার শেষে দ্বার উদঘাটন হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের এই প্রয়াস গোড়া থেকেই ব্যাপক মানুষের সমর্থন ও সহায়তায় ধন্য হয়েছে। বর্তমানে জাদুঘরের সীমিত পরিসরে প্রায় ১৪০০ স্মারক প্রদর্শিত হলেও সংগ্রহভাণ্ডারে জমা হয়েছে ১৫,০০০-এরও বেশি স্মারক।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রয়েছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ভাণ্ডার এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল সেন্টার। হৃদয় আলোড়িত করা জাদুঘর-প্রদর্শনী ও বিভিন্নমুখি কর্মতৎপরতা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিণত হয়েছে দেশে-বিদেশে নন্দিত প্রতিষ্ঠানে।
রবিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে।
সামরিক জাদুঘর
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য আর উন্নয়নের ক্রমবিকাশ সংরক্ষণ ও প্রচার করার জন্য ১৯৮৭ সালে ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসের প্রবেশদ্বারে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর। সামরিক জাদুঘরের গুরুত্ব এবং দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সামরিক জাদুঘরটি ১৯৯৮ সালে বিজয় সরণিতে স্থাপন করা হয়। রাশিয়ার তৈরি ট্যাংক পিটি ৭৬ সহ আরো ১৬টি ট্যাংক ও কামান প্রদর্শিত হচ্ছে খোলা আকাশের নীচে। এছাড়াও এ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, আরব-ইসরাইল যুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র।
মূল জাদুঘর ভবনে ৮টি গ্যালারী জুড়ে প্রদর্শিত হচ্ছে হান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিল, সেক্টর কমান্ডারগণের পোর্ট্রেট, আদিম যুগের অস্ত্রশস্ত্র, বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যক্তিবর্গের ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র, সশস্ত্রবাহিনীর পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রাক্তন সকল সেনাপ্রধানের তৈলচিত্র। রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠদের পোর্ট্রেট ও সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রদর্শনের ব্যবস্থা, বীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। জাদুঘর ভবনের নীচতলায় রয়েছে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর জিপ গাড়ি, পাক সেনাবাহিনী থেকে উদ্ধারকৃত ও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর ব্যবহৃত স্টাফ কার মার্সিডিজ বেঞ্জ।
এই জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোন টিকেট লাগে না। বুধবার এবং শুক্রবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মরণে এই জাদুঘর। আনুষ্ঠানিক নাম- ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জাদুঘরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের পশ্চিম পাশে এবং পলাশী মোড়ের উত্তর পাশে অবস্থিত। জাদুঘরটির দক্ষিণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। দ্বিতল এ জাদুঘরটিতে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মিছিল, সভা ইত্যাদির আলোকচিত্র, ভাষা শহীদদের আলোকচিত্র, প্রিয়জনকে লেখা চিঠি, ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দী পাতাল জাদুঘর
১৯৭১ এ পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের স্মৃতি বিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভবনের বায়ে দেয়ালের গায়ের পোড়া মাটির ম্যুরালে অংকন করা দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাসের এক সাক্ষী এই জাদুঘর। পাতাল জাদুঘরে প্রবেশের পর হাতের ডানে রয়েছে অডিও ভিজুয়্যাল রুম, তারপরের প্রথমে বড় খোলা গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির ছবি ও লিখিত দলিল এবং এখানেই হাতের বামে রয়েছে চমৎকার ওয়াটার ফল।
গ্যালারীতে যাওয়ার পথের দুপাশের দেয়ালে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া নির্যাতনের নর্মম চিত্র। পরের খোলা গ্যালারীতে রয়েছে ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো স্যামুয়েল এম হসকিনসন এর গোপন দলিল, গোপন বেতার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনার দালিলিক প্রমাণ এবং সেই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পনের মুহুর্তের বড় একটি ছবি।
প্রতিদিন বিকাল ৫ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই পাতাল জাদুঘর। শুক্রবার ও শনিবার এবং সকল সরকারী ছুটির দিনে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর
জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সর্বস্তরের প্রযুক্তিকে এদেশে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে আগারগাঁও শেরেবাংলানগরে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর।
দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য এখানকার সংগ্রহশালাকে বিভিন্ন গ্যালারিতে ভাগ করা হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ব্যবহৃত এক্সরে টিউবের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, কুদরাত-ই-খুদার ব্যবহৃত চশমা, ঘড়ি, কলম, সিল, সিলের প্যাড, পেপার ওয়েট প্রভৃতি ছাড়া গ্যালারিতে আছে বৈদ্যুতিক ঘন্টা, সিনেমাস্কোপ,সমুদ্রের গভীরতা নির্নয়ের যন্ত্র, পুরাতন গ্রামোফোন, হ্যালির ধুমকেতুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বর্ণনা, ভাসমান বাগানসহ ভৌত বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়, তথ্য প্রযুক্তির বিচিত্র নিদর্শন।
বিজ্ঞানকে যাদের কাছে মনে হয় নিরস বা কাঠখোট্টা তাদের কথা বিবেচনা করেই জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় রাখা হয়েছে ‘মজার বিজ্ঞান গ্যালারি’ নামে একটি গ্যালারি। এখানে প্রবেশ করলে দর্শনার্থীরা মুখোমুখি হবেন বিচিত্রসব মজার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের।
তরুণ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত যেসব প্রকল্প জাতীয় বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সপ্তাহে প্রদর্শিত হয়েছে তা নিয়ে গ্যালারিতে প্রদরশণী স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি শনি ও রবিবার সন্ধ্যা থেকে দুই ঘণ্টা জাদুঘরের ছাদে চাঁদ, শুক্রগ্রহ, মঙ্গলগ্রহ, শনিগ্রহ, এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, রিংনেবুলা, সেভেন সিস্টার্স, জোড়াতারা আর তারার ঝাঁক দেখানো হয় টেলিস্কোপের সাহায্যে।
আগারগাঁতে অবস্থিত জাদুঘরটি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত সকলের জন্য খোলা থাকে। সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার এবং সকল সরকারী ছুইটির দিনগুলোতে জাদুঘর বন্ধ থাকে।
সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উদ্যোগে সোনারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ লোকজ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বা সোনারগাঁও জাদুঘর। এই জাদুঘরের প্রতিটি গ্যালারিতে দুর্লভ সব ঐতিহ্যের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। গ্যালারির প্রদর্শনীগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে উপস্থাপিত। যেমন- নিপুণ কাঠখোদাই, গ্রামীণ জীবন, পটচিত্র, মুখোশ, নৌকার মডেল, উপজাতি গ্যালারি। এছাড়া প্রদর্শন করা হয়েছে লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, তামা, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্র গ্যালারি; লোকজ অলঙ্কার প্রদরশনের গ্যালারী।
বাঁশ, বেত, শীতলপাটি, সোনারগাঁওয়ের ইতিহাসখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা নকশিকাঁথা প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া। ফাউন্ডেশন চত্বরে কারুপল্লী গ্রাম ও কারুশিল্প গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প নামে দুটি প্রকল্প, লাইব্রেরি এবং ডকুমেন্টশন সেন্টার রয়েছে। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফাউন্ডেশন চত্বরে বছরে দুটি মাসব্যাপী লোকজ উৎসবসহ বিভিন্ন দিবসগুলোতে মেলা উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেলা প্রাঙ্গণে গ্রামীণ বিভিন্ন জীবনযাত্রার আলোকে স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে লোকজ জীবন প্রদর্শন এবং স্থানীয়দের অংশগ্রহণে গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
লালবাগ কেল্লার জাদুঘর
বর্গাকৃতির সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা লালবাগ কেল্লার প্রথমেই নজরে আসে বিশাল তোরন/ফটক। শায়েস্তা খাঁনের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি সৌধ, সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের বাসভবন ও দরবার হল ছাড়াও এই জাদুঘরটিতে শায়েস্তা খানের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী। রয়েছে তৎপূর্ব ও তৎকালীন সম্রাট ও শাসকদের শাসনামলে ব্যাবহৃত মুদ্রা উল্লেখ্য সে সময়কার মুদ্রাগুলো বিভিন্ন ধাতব উপাদান দ্বারা তৈরী হত। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে মুঘল আমলে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রসস্ত্রগুলো ১৭ শতকের বর্শাফলক, লোহার জালের বর্ম, ঢাল, তরবারী, দস্তানা, পারকাশন লক বন্দুক ও রাইফেল, তীর ধনুক, ফ্লিন্ট লক পিস্তল, ফ্লিন্ট লক কামান, পারকাশন লক পিস্তল, সৈনিকদের পোশাক, রাজার পোশাক এবং সীসার গুলি। ১৭শ শতকের পারস্যে তৈরী তিনটি কার্পেট, ঝারবাতি, ল্যাম্প, জায়নামাজ, শিলালিপি, মুঘল চিত্রকলা ইত্যাদি।
জাদুঘরটি রবিবার পূর্ণ দিবস বন্ধ থাকে ও সোমবার অর্ধ দিবস পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘর
বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পাশে আহসান মঞ্জিল অবস্থিত। ঢাকার নবাব পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত এই প্রাসাদটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে আহসান মঞ্জিলের মূল প্রাসাদটিতে ২৩টি গ্যালারী রয়েছে। এখানে নবাবদের ব্যবহৃত উনিশ শতকের সৈনিকের বর্ম, ভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সংস্কারপূর্ব ও পরবর্তী আলোকচিত্র ও পেইন্টিং, আহসান মঞ্জিল নিলামে বিক্রির জন্য এবং নতুন ভবন তৈরীর নির্দেশ নামা, আলমারী, তৈজসপত্র, ফানুস ও ঝাড়বাতি, প্রাসাদ ডাইনিং রুম, নবাবদের আনুষ্ঠানিক ভোজন কক্ষ, দরজার অলংকৃত পাল্লা, ঢাল-তরবারী, বল্লম, বর্শাফলক, মুসলিম লীগ কক্ষ, সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দর একটি বড় ছবি। ঢাকায় বিদ্যুৎ, কেরোসিন বাতি, হারিকেন চুল্লি, হারিকেন সার্চ বাতি, দেশে বিদেশে জনকল্যাণ কাজে ঢাকার নওয়াবদের অর্থদানের বিবরণ, সিগন্যাল বাতি, বিভিন্ন বিদেশী বৈদ্যুতিক বাল্ব, কেরোসিন চালিত পাখা, বিভিন্ন প্রকার কাঁচের লাইট, মোমবাতি ষ্ট্যান্ড, ফানুস রয়েছে।
সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এবং সকল সরকারি ছুটির দিনে জাদুঘর বন্ধ থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক জনপ্রতি বাংলাদেশী দর্শকের জন্য টিকেট মূল্য ৫ টাকা। প্রতিবন্ধী দর্শকদের জন্য কোন টিকিটের প্রয়োজন হয় না। পূর্ব থেকে আবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে জাদুঘর দেখতে দেয়া হয়।
শিশু জাদুঘর
বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর কেন্দ্রীয় চত্বরে দোতলা শিশু জাদুঘরটি শিশুদের সামনেএদেশের ইতিহাস- ঐতিহ্য- সংস্কৃতিকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করার এক চেষ্টা। ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিশু-কিশোরদের ব্যবহৃত ছবি, জিনিসপত্র, বই, খাতা, কলম, গ্লাস, প্লেট, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খেলনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের জিনিসপত্তর দিয়ে সাজানো রয়েছে গ্যালারী। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবারে এ জাদুঘর বন্ধ থাকে।
বাঙালি সমগ্র জাদুঘর
ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগন্যাল মোড়ের এই জাদুঘরটি ২০০৪ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে বায়ান্নতম বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যথাযথভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীর্তিমান বাঙালির অবদান, তাদের সৃষ্টি ও কর্ম স্থায়ী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে এলিফ্যান্ট রোডের খায়ের ম্যানসন ভবনে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই জাদুঘর তার যাত্রা শুরু করে।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়াত বিশিষ্ট বাঙালির পঞ্চাশের বেশি প্রোর্ট্রটে বা প্রতিকৃতি রয়েছে এ জাদুঘরে। যারা ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্য, সংগীত-নাটক-চলচ্চিত্র-ক্রীড়া, সমাজ-রাজনীতি-সর্বনীতি এবং বিজ্ঞান-স্থাপত্য-শিল্পকলায় অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার মূল কপি, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু (১৯২২) পত্রিকা, বেগম রোকেয়ার হাতের লেখা চিঠির মত বেশ কিছু অনন্য স্মারক সংগৃহীত রয়েছে এখানে। এছাড়া রয়েছে জীবন ও কর্মভিত্তিক সাক্ষাৎকারমূলক তথ্যচিত্র। সচল প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে।
বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়েদ উল হক, প্রথম বাঙালি মুসলমান চিত্রকর কাজী আবুল কাশেম,ফিরোজা বেগম, কবি আবুল হোসেন, কবি শামসুর রহমান, নাট্যকার সাঈদ আহমেদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের জীবনীচিত্র। প্রায় দুই হাজার স্থানীয় পুস্তক নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি গ্রন্থাগার।
উদ্ভিদ জাদুঘর
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া উদ্ভিদজগতের বৈশিষ্ট্য এবং তথ্য বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঢাকার মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে প্রতিষ্ঠিত 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম' বা উদ্ভিদ জাদুঘর পরিবেশ, বৃক্ষ সংরক্ষণে আগ্রহী বা উদ্ভিদপ্রেমীদের দর্শনের জন্য এক চমৎকার স্থান। প্রতিষ্ঠানটিকে কাঠামোগত রূপদানের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন প্রখ্যাত ট্যাক্সোনমিস্ট ড. সালার খান।
এই হার্বেরিয়ামে সংরক্ষণ করা হয় নানা জাতের উদ্ভিদের শুকনো বীজ এবং নমুনা, গোত্র, প্রাপ্তিস্থান, প্রাপ্তিকাল, সংগ্রাহকসহ প্রয়োজনীয় নানা তথ্য। টেক্সোনমি, টিস্যু কালচার, সাইটোজেনেটিক্স এবং অ্যানাটমি এই চার অংশে সাজানো আছে এই দেশের উদ্ভিদের এক বিপুল সংগ্রহশালা।
ডাক জাদুঘর
জিপিওর ভেতরে ডাক ভবনে ডাক অধিদপ্তরের তৃতীয়তলার পশ্চিম পাশে অবস্থিত এ জাদুঘর এক ভিন্নধর্মী জাদুঘর। রানি ভিক্টোরিয়ার সময়কার ডাকবাক্স সহ নানান গঠনের ডাকবাক্সের পাশাপাশি এখানে দেখতে পাবেন ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নভুক্ত ১৯১টি দেশ থেকে সংগৃহীত ডাকটিকিট । রয়েছে ডাক বিভাগের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ব্যবহৃত নানান দর্শনীয় বস্তু, ডাক বিভাগের সঙ্গে জড়িত দেশ-বিদেশের অনেক ব্যক্তির ছবি, পাঞ্চিং করার পুরনো মেশিন ও পোস্টম্যানদের ব্যবহৃত ঘড়ি, পোস্টম্যানদের ব্যবহৃত ব্যাগ, মানিকট ব্যাগ, চামড়ার ব্যাগ, ব্যাগ কাটার ছুরি, তালা, নানা আকৃতির তালার চাবি, যুগ যুগে ব্যবহৃত সিলমোহর ও প্রকাশনা।
ডাক জাদুঘরে সাজানো আছে পোস্টম্যান্দের ব্যবহৃত ঘুঙুর লাগানো বর্শা, নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত তলোয়ার ও বন্দুক। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে ডাক জাদুঘরটি। জাদুঘরের ঢুকতে কোনো প্রবেশ মূল্য লাগবে না।
রাজারবাগের জাদুঘর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম যেখানে আক্রমণ চালিয়েছিলো ঢাকায় সেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে পুলিশ সদস্যদের ওই গৌরবোজ্জ্বল ত্যাগকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এখানে রয়েছে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা ও ইউনিফর্ম, ঘন্টা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেতারে যেই ভাষণ দিয়ে পুলিশ সদস্যদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই ভাষণের কপিও রাখা হয়েছে জাদুঘরে। এছাড়া রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র এবং পোস্টার। সকল সরকারী কার্যদিবসে জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকে সর্বসাধারণের জন্য।
নগর জাদুঘর
নগর ভবনের ষষ্ঠ তলার হলঘরে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত এই জাদুঘরে রয়েছে ঢাকার সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের বেশ কিছু সংগ্রহ। রয়েছে মোগল এবং ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল, ছবি এবং গ্রন্থসহ নানা জিনিস। ঢাকার ১৯৮৯, '৫২, '৬৬, '৬৭ ও ১৯৭১ সালসহ নানা আন্দোলনের আলোকচিত্র এবং পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কাটিংও রয়েছে। সকল সরকারী কার্যদিবসে জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকে সর্বসাধারণের জন্য।
প্রাণী জাদুঘর
মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা চিড়িয়াখানার ভেতরে রয়েছে প্রাণী জাদুঘর। প্রাণী জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে মৃত ডলফিন থেকে বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল, মৃত দেহের মমি প্রভৃতি। চিড়িয়াখানায় প্রবেশের টিকেট ১০ টাকা এবং প্রাণী জাদুঘরের টিকেট মাত্র দুই টাকা।এখানে রয়েছে মমি করে রাখা চিতা বাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান বাঘ, শিম্পাঞ্জি, শেয়াল, বাঘডাস, ক্যাঙ্গারু।
বিমান বাহিনী জাদুঘর
বেগম রোকেয়া সরণি ও কম্পিউটার সিটির (আইডিবি ভবন) পশ্চিমে, আগারগাও মেট্রো স্টেশন ঘেঁষে এই জাদুঘর। সুদৃশ্য হ্রদ এবং সবুজ বৃক্ষসারি বেষ্টিত এই জাদুঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি বিজড়িত মোট ২১টি বিমান, দুটি হেলিকপ্টার ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত দুটি রাডার। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম যাত্রীবাহী বিমান 'বলাকা' জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ। ত্রিশ টাকার টিকেট কেটে বলাকার ভেতরে প্রবেশ করে ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে দেয়া ভারতের উপহার ডাকোটা বিমান এবং সেই ক্রান্তিলগ্নে ব্যবহৃত 'অ্যালিউট' হেলিকপ্টার।
ডাকসু সংগ্রহশালা
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু ভবনের নিচতলায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মিনি জাদুঘর'। এ দেশের মুদ্রা, দুর্লভ আলোকচিত্র, পুস্তক, পোস্টার, পত্রিকা কাটিং, ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংবলিত ছবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র ইত্যাদি ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষিত আছে এখানে। এখানে সংরক্ষিত আছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আমতলার আমগাছের ধ্বংসাবশেষ। এছাড়া রয়েছে ৩৫ জন ভাষাসৈনিকের মুদ্রিত সাক্ষাৎকার।
টাকা জাদুঘর
আবহমান কাল ধরে বাংলার বিভিন্ন সময়ের ধাতব মুদ্রা এবং কাগুজে নোট সংরক্ষণ স্থান এবং প্রদর্শনী টাকা জাদুঘর অবস্থিত মিরপুরে। এখানে রয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ ২য় শতক পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপ অঙ্কিত মুদ্রা, ৭ম ও ৮ম খ্রিষ্টাব্দের হরিকেল মুদ্রা, ১৪শ ও ১৫শ শতকের বাংলার বিভিন্ন শাসকের টাকশাল থেকে সংগৃহীত মুদ্রা।
এ জাদুঘরে বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলক শাহ, মোগল সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, ফররুখশিয়ার ও ব্রিটিশ আমলের স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র মুদ্রা এবং কাগজের নোট। এছাড়াও এখানেদেখতে পাবেন ব্রিটিশ পরবর্তী পাকিস্তান আমল, স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা ও কাগজের নোটের ধারাবাহিক পরিক্রমা, প্রায় ১২০টি দেশের বিভিন্ন সময়ের কাগজের নোট, পলিমার, হাইব্রিড নোট, পোলিশ ব্যাংক নোট, চেক ও বন্ড। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বহু সাধারণ মানুষ নিজেদের যত্নে রাখা শখের দুষ্প্রাপ্য সব মুদ্রা এই জাদুঘরে দান করেছেন।
তবে আফসোসের বিষয় হলো অধিকাংশ জাদুঘরগুলোতে নিদর্শনগুলো সম্পর্কে দর্শনার্থীদের অবহিত করার জন্য কোনো গাইড নেই। প্রতিটি বস্তুই সাক্ষী দিচ্ছে প্রত্যক্ষ ইতিহাসের, কিন্তুই গল্প গুলো মিলে যাচ্ছে অজানায়। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ধুলা পড়ে যাচ্ছে আমাদের সংরক্ষিত সংস্কৃতি ইতিহাসের শোকেসের কাঁচে।
purbasha-2017413525@devs.du.ac.bd