
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :

হাওর, জঙ্গল, মহিষের শিং এই তিনে ময়মনসিং(হ)- প্রবাদ প্রবচনে এক সময় এভাবেই পরিচয় করানো হতো তৎকালীন ভারতবর্ষের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহকে। বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা এই শহরকে করেছে আরও সমৃদ্ধ।
এক সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছিলো রাজা-মহারাজা ও জমিদারদের বসবাস।দীর্ঘ সময় ধরে এ অঞ্চল শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা। রাজা-মহারাজাদের শাসনামলে এ অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। গৌরীপুর লজ হচ্ছে তেমনি একটি।
গৌরীপুর লজটি অবস্থিত ময়মনসিংহ জেলা শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের অদূরে ঈশান চক্রবর্তী রোডে। দ্বিতল বিশিষ্ট স্থাপনাটি এ অঞ্চলের অন্যান্য স্থাপনা থেকে একটু ভিন্ন কারণ এটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে লোহা, টিন ও কাঠ।

ধারণা করা হয়, তৎকালীন ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত সেন গৌরীপুরের রাম গোপালপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে এক টুকরো জমি দান করেন। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেন যে, এই জমিতে কোনো ইট-পাথরের দালান তোলা যাবে না।
পরবর্তীতে এই শর্ত মেনে ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় আনুমানিক ১৮২৮ সালে নির্মাণ করেন প্রাচীনতম নিদর্শনের লজটি। বাড়িটি তৈরিতে সুদূর চীন থেকে মিস্ত্রী আনা হয়েছিল। নির্মাণের পর তিনি এই বাড়ি উপহার হিসেবে তাঁর জামাতাকে দান করেন এবং নাম দেন গৌরিপুর লজ।
গৌরিপুর রাজবাড়ির পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন একজন প্রকৃতি প্রেমী ও জ্ঞানী মানুষ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, মহারাজ উপাধি পাওয়ার জন্য তিনি ‘রাজা’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

১৮৮৯ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীকে নবাব উপাধি প্রদান করেন। কিন্তু তার আগে দুইবার ব্রিটিশ সরকারের 'বেগম' উপাধি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তৎকালীন সময়ে শিক্ষা খাতে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা দান করেন। তৎকালীন সময়ে সারা পূর্ব বাংলায় শিক্ষাখাতে তিনিই সবচেয়ে বেশি অনুদান দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে মহারাজ উপাধি পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল।ফলে বাড়িটি নির্মাণ করে ইংরেজদেরকে নিজের যোগ্যতা দেখানো ছিল ব্রজেন্দ কিশোরের জন্য চ্যালেঞ্জ।
দ্বিতল এই বাড়িটিতে ঝুলবারান্দা, ড্রইং, ডাইনিংসহ ছোট-বড় মোট ২০টি রুম রয়েছে। জমিদার বাড়িটি বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এক দশমিক ৩৬ একর জমির ওপর নির্মিত বাড়িটির সামনে রয়েছে বিভিন্ন ফুল-ফলে সমৃদ্ধ একটি বাগান। রয়েছে শান-বাঁধানো পুকুরঘাট।
বাড়িটির পেছনে রয়েছে অসংখ্য গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশ। দৃষ্টিনন্দন নকশা দিয়ে ভরপুর বাড়িটির দেয়াল। লোহা দিয়ে তৈরি হয়েছে রেলিংগুলো। জানালা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে মজবুত কাঠ যা এতো বছর পরেও টিকে রয়েছে।
নিচ থেকে ওপর তলায় উঠার জন্য কাঠের তৈরি সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। সিঁড়ির হাতলগুলোতে ফুটে উঠেছে নান্দনিক নকশা।
প্রাসাদের প্রধান সুরঙ্গ থেকে একটু এগিয়ে গেলে দু’টি সিংহের মুখোমুখি অবস্থানে সিমেন্ট, চুন আর কাঁচ দিয়ে নির্মিত ঐতিহাসিক সিংহ দরজা চোখে পড়ে। তখন ডানে -বামে পেছনে রাজপরিবার, অতিথি আর কর্মচারীদের জন্য তৈরি পৃথক পৃথক শান বাঁধানো পুকুরঘাট ভ্রমণ পিপাসুদের মনে জাগায় অদম্য কৌতূহল। কল্পনায় ভাসে তাদের আভিজাত্যের ছবি। জমিদার বাড়িটিতে এসেছিলেন আলাউদ্দিন আলী খাঁ, মুহম্মদ আলী খাঁ, হাফেজ আলী খাঁ, মুস্তফা খাঁ সহ সঙ্গীত জগতের পুরোধা ব্যক্তিরা।

ময়মনসিংহের বাংলো নামে পরিচিত জমিদার বাড়িটি বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের জোনাল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটিতে থাকেন সরকারি কর্মকর্তারা। যে কেউ যে কোনো সময় এটি পরিদর্শন করতে পারেন। তবে ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে থাকতে হবে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনুমতি।
কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে সড়ক পথে ময়মনসিংহে আসতে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা, সৌখিন সহ বেশ কয়েকটি পরিবহন বাস রয়েছে। সময় লাগবে আড়াই থেকে চার ঘন্টা। রেলপথেও ময়মনসিংহে আসতে পারবেন। মাসাকান্দা বাসস্ট্যান্ডে অথবা রেল স্টেশনে নেমে রিক্সা অথবা অটো করে শহরের শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ মোড়ে নামতে হবে। ব্রীজ থেকে অটো বা রিক্সা করে সহজেই পৌঁছে যাবেন গৌরীপুর লজে।
mohammadullahtusher@gmail.com

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.