Bangla
3 years ago

কালিদাসের মেঘদূত ঝড়ুক বর্ষা হয়ে

রামগোপাল বিজয়বৈরাগ্যের আঁকা মেঘদূতের চিত্র ।  ছবি: রোর মিডিয়া
রামগোপাল বিজয়বৈরাগ্যের আঁকা মেঘদূতের চিত্র । ছবি: রোর মিডিয়া

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

এরকম তীব্র গরমের মধ্যে বর্ষা শব্দটি শুনলে মন যেনো একা একাই বলে উঠে, “ইশ! একটু বৃষ্টি হতো যদি!” চাইলেই বর্ষার বারিধারা আকাশ ভেদ করে নামবে না সত্যি কিন্তু বর্ষার সেই আবহ, সেই অনুভূতির মাঝে ঘুরে আসা একদম অসম্ভব কিছু না। 

তাহলে আর দেরি না করে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া যাক। এমন একসময় ফিরে যাওয়া যাক যখন প্রযুক্তির বিপ্লব থেকে মানবসভ্যতা তখনো কিছুটা দূরে। চাইলে প্রিয়জনের কাছে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো কিংবা মুঠোফোন বা টেলিফোন ঘুরিয়ে সংলাপ জুড়ে দেওয়ার উপায় নেই। এমন একদিনে আকাশ অকস্মাৎ মেঘলা হয়ে নামলো ঝুম বৃষ্টি। এরকম আবহ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই মনে আপনা আপনি এক তীব্র আকুলতা জন্মায়। সব বাধা পেরিয়ে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করে প্রিয়জনের কাছে। 

বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনগুলোতে প্রকৃতি যেমন নবরূপ নেয়, তেমনি মানুষের মনেও জন্ম নেয় নানা মাত্রার চিন্তা। আর এ চিন্তাকেই যুগ যুগ ধরে কবি সাহিত্যিকরা রুপ দিয়েছেন বহুমাত্রিক শিল্পে। সে শিল্প প্রস্ফুটিত হয়েছে কখনো গানরূপে, কখনো কবিতারূপে, কখনো আবার গল্প কিংবা উপন্যাসরূপে। বৃষ্টিস্নাত দিনে প্রেমিকার কাছে আকুল নিবেদন জানাতে পৃথিবীর নানান প্রান্তে রচিত হয়েছে কত শত কাব্য মহাকাব্য। এমনই এক বর্ষাকাব্য রচনা করেছিলেন কবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ নামে। 

শুনতে সাধারণ প্রেমপত্রের মতো মনে হলেও মেঘদূত কোনো সাধারণ কাব্য নয়। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এ কাব্য নিজস্ব সংস্কৃতির গন্ডি পেরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের দূর দূরান্তের ভাষা সাহিত্যের মানুষের মনে। বর্ষায় মানবমনের আকুলতা যে কতোটা সূক্ষ্মভাবে কালিদাস তার এ কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তা মেঘদূত না পড়লে হয়তো বোঝা যাবে না। 

'মেঘদূত' কাব্যের মূল চরিত্র যক্ষ এবং তার স্ত্রী। অলকানগরীর বাসিন্দা যক্ষ এক ধনপতি কুবেরের বাগান দেখাশোনা করতো এবং তার সেবায় নিয়োজিত ছিলো। সবকিছু ভালোই চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ একদিন ঘটলো অনিষ্ট। হাতির পাল বাগানে ঢুকে পুরো বাগান নষ্ট করে ফেললো। বাগানের দেখাশোনার দায়িত্বে যেহেতু যক্ষ ছিলো তাই তার উপরই সমস্ত দায় পড়লো। ফলশ্রুতিতে যক্ষকে নির্বাসিত করা হলো রামগিরিতে। 

প্রিয়তমার বিরহ হৃদয়ে ধারণ করে যক্ষ দিন কাটাতে লাগে রামগিরিতে। প্রকৃতির পালা বদলে ঋতু পালটে আসে আষাঢ় মাস। কবির ভাষায়, 

"আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং

বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ॥"

সারমর্ম এই যে আষাঢ়ের প্রথম দিনেই মেঘের ঘনঘটায় যে আবহ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তার মন আনচান করছে তার প্রিয়তমার কাছে যাওয়ার জন্য। আর এ কারণেই সে মেঘের কাছে আবেদন করে তার বার্তা যেনো সুদূর অলকানগরীতে তার পত্নীর কাছে পৌঁছে দেয়। মূলত মেঘের সাথে এ কাল্পনিক সংলাপ দিয়েই শুরু হয় সংস্কৃত সাহিত্যের বহুল সমাদৃত 'মেঘদূত' কাব্য।

১১৮টি শ্লোকের সমন্বয়ে রচিত 'মেঘদূত' কাব্যের দুটি খন্ড; উত্তরমেঘ ও পূর্বমেঘ। 

মূলত ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয় পূর্বমেঘ দিয়ে এবং শেষ হয় উত্তরমেঘে যেয়ে।

পূর্বমেঘের শুরুতে মূলত পরিচয় হয় মূল চরিত্র যক্ষ, তার প্রেয়সী এবং অলকানগরী সম্পর্কে জানা যায়। এ অংশের প্রথম দিককার কাহিনি ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। কিন্তু এ কাব্যের মূল আকর্ষণ শ্লোক ১৬ থেকে ৬৪। এ অংশে বর্ণিত হয়েছে মেঘের যাত্রাপথ নিয়ে। 

প্রথমে শুনে মনে হতেই পারে যে, মেঘের যাত্রাপথে কি এমন আছে যে কাব্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক বলা হচ্ছে এ অংশকে। 

এখানেই কবি কালিদাস তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। মূলত মেঘ যখন যক্ষের বার্তা নিয়ে রামগিরি থেকে অলকানগরীতে যাচ্ছিলো, তখন মেঘের যাত্রাপথের যে সৌন্দর্য তাই বর্ণনা করা হয়েছে শ্লোক ১৬ থেকে ৬৪ তে। 

 

"পাণ্ডুচ্ছায়োপবনবৃতয়ঃ কেতকৈঃ সুচিভিন্নৈঃ-

নীড়ারম্ভৈর্গৃহবলিভুজামাকুল্গ্রামচৈত্যাঃ। "

 

শুধুমাত্র এ দুই পঙ্কতিতে কি অনিন্দ্যসুন্দর উপমা ব্যবহার করেছেন কবি তা সংস্কৃত না বুঝলে বোঝা দায়। 

কিন্তু চিন্তার কোনো কারণ নেই। ভাষা না বুঝলেও অনুবাদ তো বোঝা যাবেই। 

 

অনুবাদ করলে এ অংশের অর্থ দাঁড়ায়, "পূর্বমেঘ পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠবে অলকানগরীর যাত্রাপথে উজ্জয়নী, অবন্তি অথবা বিদিশা নগরীর দৃশ্য। কিংবা কানে বেজে উঠবে রেবা, শিপ্রা ও বেত্রবতী নদীর বহমান জলধারার কলকল ধ্বনি ও ভেসে আসবে নদীর ধারের ভুঁইচা.

খানিকটা মনোযোগ দিয়ে পড়লে হারিয়ে যেতে হবে রামগিরি থেকে অলকানগরী যাওয়ার পথে৷ আদতে রামগিরি থেকে অলকানগরীর দূরত্ব অনেক। বহু নগর, পাহাড়, বন, নদী পেরিয়ে মেঘ পৌঁছায় অলকানগরীতে আর 'মেঘদূত' কাব্য পৌঁছায় পূর্বমেঘ থেকে উত্তরমেঘে। 

উত্তরমেঘে যাওয়ার আগে পূর্বমেঘের আরো কিছু সুনিপুণ অনিন্দ্যসুন্দর বর্ণনার সাগরে ডুব দিয়ে আসা যাক। 

এ অংশে কখনো সন্ধ্যা নামে কৈলাশ কিংবা দেবগিরি পাহাড়ের চূড়ায়। কখনো অজান্তেই হারিয়ে যেতে হয় কেতকীবেষ্টিত উপবনে। নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য আছে রেবা, শিপ্রা, বেত্রবতী নদী। এছাড়াও প্রতি পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়াবে বর্ষার স্নিগ্ধ সতেজ কদমগুচ্ছ। অনেকের মনে হয়তো ইতোমধ্যে বেজে উঠেছে, "একগুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে।"

পূর্বমেঘ পাড়ি দিয়ে এবার উত্তরমেঘে যাওয়ার পালা। 

মেঘ এখন পৌঁছে গিয়েছে সুদূর অলকানগরীতে। শ্লোকের পর শ্লোক পার করে যক্ষের প্রেয়সীর বাড়িও খুঁজে পাওয়া গেলো। তার বাড়ির বিবরণ দিতে কবি লিখেছেন, 

"বাসশ্চিত্রং মধু নয়নয়োর্বিভ্রমাদেশদক্ষং

পুষ্পোদ্ভেদং সহ কিসলয়ৈর্ভূষণানাং বিকল্পান্

লাক্ষারাগং চরণকমলন্যাসযোগ্যঞ্চ ষস্যা-

মেকঃ সূতে সকলমবলামণ্ডনং কল্পবৃক্ষঃ।।"

এখানে প্রথমেই পাশের বাড়ির উঠোনে থাকা একটি মন্দার গাছের কথা উঠে এসেছে। বাড়ি থেকে কিছু দূরে আছে পান্নাশোভিত পদ্মের কান্ডে ছেয়ে থাকা একটি হ্রদ। সেখানে আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল।

মেঘদূতের এ অংশ পড়তে যেয়ে পাঠক মনও ব্যাকুল হয়ে উঠে যক্ষের প্রেয়সীর দেখা পাওয়ার জন্য। যাকে ঘিরে এতো শতো ভাবনা, যার জন্য মেঘমালা পাড়ি দিলো রামগিরি থেকে সুদূর অলকানগরী, যক্ষের সে প্রেয়সী কোথায়? কোথায় সে রূপবতী? 

খুব বেশি অপেক্ষা না করে তাহলে উদ্ধৃত করা যাক কালিদাসের বিখ্যাত সে শ্লোক, যাতে যক্ষপ্রিয়ার রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। 

"তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী"

অনুবাদ করলে দাড়ায়, "হালকা গড়ন ও ঈষৎ শ্যামলা বর্ণ।" 

এরপর শত শত রূপক ও উপমার মোড়কে কবি কালিদাস একটু একটু করে সাজিয়েছেন যক্ষের প্রাণপ্রিয় পত্নীকে। 

 

এ শ্লোকগুলোর সৌন্দর্য এবং মোহ সংস্কৃত সাহিত্যের গন্ডি পেরিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে ভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যের মানুষকেও। কবি কালিদাস শুধুমাত্র যক্ষপ্রিয়ার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন এমন নয়। যক্ষের বিরহে নির্ঘুম রাত্রিযাপন করে তার কী রকম জীর্ণ দশা হয়েছিলো তাও বর্ণিত হয়েছে দারুণ ভঙ্গিমায়। 

এতো দুঃখের মাঝেও সুখের কথা হলো মেঘ যক্ষের বার্তা নিয়ে পৌঁছতে পেরেছিলো যক্ষপ্রিয়ার কাছে, দিতে পেরেছিলো যক্ষের প্রেমেভরা সে বার্তা। আর এরই সাথে পূর্নতা পায় কালিদাসের অমর সৃষ্টি 'মেঘদূত'।



মোঃ ওমর ফারুক তপু বর্তমানে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

jafinhasan03@gmail.com

শেয়ার করুন