Bangla
2 years ago

কবিতায় বিপ্লব, বিপ্লবের কবিতা

ছবি: কোরা
ছবি: কোরা

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

কবিতা প্রেমের কথা বলে, কবিতা জীবনের কথা বলে। কবিতা বিপ্লবের ভাষায় জেগে ওঠে, কবিতা কবির আদর্শ নিয়েও ধরা দেয় পাঠকের চোখে। এ লেখায় আসবেন বিংশ শতাব্দীর পাঁচ কবি এবং তাদের বেশ বিখ্যাত পাঁচটি কবিতা।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)

প্রথমেই যে কবিতাটি নিয়ে আলোচনা হবে, সেটি নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মাইলফলক, বিশ্বকবি কাজী নজরুলের ইসলামের ‘বিদ্রোহী’।

মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না –

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

এই কবিতার পরিসর আকারে ও প্রকারে, উভয় দিক দিয়েই বেশ বিস্তৃত। এতে অনেক অংশ রয়েছে। এবং সেসব অংশে ব্যক্তি অনুভূতি থেকে শুরু করে দলগত সংকল্প- সবটাই এসেছে। জীবনের প্রতিটি পরিসরে বিদ্রোহ কীভাবে ব্যক্তিকে পরিচালিত করে, সেটিই এ কবিতার মূলকথা। সময়ের দিক দিয়ে দেখলে নজরুল যখন এটি লিখেছিলেন, তখন বিশ্বে বিরাজ করছিল তুমুল অস্থিরতা। এবং সে অস্থিরতার ছাপ ধরা দিয়েছে নজরুলের লেখনীতে। বাংলাদেশের প্রথম নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য।

“প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।”

এখানে কবি হয়ে উঠেছেন শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের মরম বেদনা, এবং তার বহিঃপ্রকাশ- প্রতিবাদ। তিনি এখানে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন সেইসব অত্যাচা শাসকের বিরুদ্ধে, যারা যুগে যুগে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে তথাকথিত দুর্বলদের। এখানে কবিতা হয়ে উঠেছে নিপীড়িতের জ্বালাময়ী কণ্ঠস্বর।

সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭)

এর পরের কবিতাটি লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। জীবনের ক্ষীণ সীমানাতে সুকান্ত যে জীবনবোধকে আত্মস্থ করেছিলেন, তার কবিতায় তার স্ফূরণ ঘটেছে বারবার। সুকান্তের ‘লেনিন’ কবিতাটিও যেন সে কথাই বলে।

লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,

অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।

মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস

মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।

লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,

বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।

‘লেনিন’ কবিতার লেনিন মূলত ভ্লাদিমির লেনিন। তিনি একজন রাশিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লবী এবং বলশেভিক পার্টির প্রধান। সুদূর রাশিয়ার এক রাজনীতিবিদকে এই বাংলায় বসে কবি সুকান্ত, ইন্টারনেটেরও যুগে বহু আগে উপলব্ধি করেছেন নিজের বিপ্লবী সত্ত্বায়, তার কবিতায়। উল্লেখ্য যে, সুকান্তের জন্মের দু বছর আগে লেনিন মারা যান। কিন্তু এতেও লেনিনকে তার দূরের কেউ মনে হয়নি। কেননা বিপ্লব তার কাছে ধরা দিয়েছে একজন ব্যক্তি হিসেবে, তার রাজনৈতিক চেতনার সংযোগ ঘটেছে একজন ব্যক্তির সাথে। এখানে দল মুখ্য হয়নি, রাষ্ট্র বা ভৌগোলিক সীমারেখা গুরুত্ব পায়নি। সময়ের সীমারেখাও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তার কাছে গুরুত্ব পেয়েছে শুধু একটি নাম। লেনিন। চেতনা, মতাদর্শ, দল ইত্যাদি যতটা না বিশেষ হয়ে ওঠে, তার চাইতে বেশি বিশেষ হয়ে ওঠেন একেকজন ব্যক্তি। একেকটি নাম। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতির ব্যক্তিকরণের চর্চা যেন সাহিত্যেও প্রকাশিত হয়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২)

সুকান্ত যেভাবে লেনিনকে তার কবিতায় এনেছেন, ঠিক সেভাবেই কিউবান বিপ্লবের অধিনায়ক চে গুয়েভারাও এসেছেন বাংলা কবিতায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চে গুয়েভারার প্রতি’ কবিতাটি তারই উদাহরণ।

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-

বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা

তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর

তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে

নেমে গেছে

শুকনো রক্তের রেখা

চোখ দুটি চেয়ে আছে

সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে ছুটে আসে অন্য গোলার্ধে

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

যে বিপ্লবী জীবনের সমাপ্তি চে’র ক্ষেত্রে হয়েছিল, তা সুনীল চাননি। চে’র মৃত্যুকে সুনীল গ্রহণ করেছেন ব্যক্তিগত ক্ষতি হিসেবে। আগের কবিতায় যেভাবে কবির চেতনা রাজনৈতিক ব্যক্তিকরণের ছাঁচের মধ্যে প্রবেশ করেছে, এ কবিতাতেও তাই। ভৌগোলিক সীমারেখা এখানেও কোনো প্রভাব রাখেনি, না রেখেছে সময়।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১)

এখন কথা হবে এই কবিদের অনেক পরের সময়ের একজন কবি নিয়ে। প্রেম ও দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহের এই কবিতাটির একটি লাইন কিছুদিন আগ পর্যন্তও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের সামনে লেখা সেই লাইন দেখে হয়তো অন্যমনস্ক শিক্ষার্থীর মনেও প্রশ্ন জাগে, আসলেই তো- কোন পক্ষে যাব? হয়তো বাস্তবতার সাথে তাল মেলাতে শেষমেশ মধ্যপন্থাতেই বিচরণ করা হয়।

দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

একদিকে বিত্তবান,

অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত মানুষ

একদিকে পুঁজিবাদ,

অন্যদিকে সাম্যবাদী শান্তির সমাজ

এখানে কবি খুব স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিয়ে সাদা-কালো, ভালো-মন্দ দুটো পক্ষ দাঁড় করাচ্ছেন। এবং পাঠককে তিনি সরাসরি প্রশ্ন করছেন, তার বলে দেয়া সেই দুটো পক্ষের কোনটিতে তারা যাবে? একদিকে তিনি যখন বিত্তবানকে রাখছেন, তখন তাতে কোনো বিশেষণ ব্যবহার করেননি। অন্যদিকে বিত্তহীনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন দুটো শব্দ ‘ক্ষুধার্ত মানুষ’। এবং এই শব্দ দুটো জুড়ে দেয়া খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কবি চাইছেন, পাঠক যেন দ্বিতীয় পক্ষের সাথে সংযোগ অনুভব করে, মানবিক আবেদন বোধ করে। বিত্তহীনের জন্য যেন পাঠকের মনে সহানুভূতি জন্মায়, সেটিই তার চাওয়া। ঠিক একইভাবে তিনি আমাদের সামনে দাঁড় করাচ্ছেন পুঁজিবাদকে। পুঁজিবাদ যেন এখানে একটি সাধারণ শত্রু, একটি বর্ধমান সমস্যা। যার সমাধানও তিনি দিয়ে দিয়েছেন অন্য একটি সমাজের কথা বলে, সাম্যবাদী সমাজ- কবি ও কবিতার ভাষায় যা শান্তির সমাজ। তাই প্রথমে প্রশ্ন করে শুরু হলেও কবিতাটিতে কিন্তু প্রশ্ন নয়, উত্তরই উঠে এসেছে। পাঠককে বরং এখানে বলে দেয়া হচ্ছে, কোন পক্ষে তাদের যাওয়া উচিত। কবির নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা এখানে রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক সচেতনতার।

নবারুণ ভট্টাচার্য (১৯৪৮-২০১৪)

কবিতা কোনো বাধাকে স্বীকার করে না

কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।

চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার

তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি

বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে

গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।”

দুটো প্রত্যয় এখানে বেশ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমির। ‘সশস্ত্র’ এবং ‘গেরিলা ছন্দ’। দুটোই ইঙ্গিত দিচ্ছে একসময়ের টালমাটাল কলকাতায় নকশালবাদী আন্দোলনের এবং কবি এখানে কবিতা ও আন্দোলনকে কোথাও একটা মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন, যাতে পাঠকের কাছে দুটো সমার্থক মনে হয় এবং নির্দিষ্ট এই আন্দোলনটির প্রতি সংযোগ অনুভব করে।

এছাড়াও এ কবিতায় উঠে এসেছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর কঠোর সমালোচনা। রাষ্ট্রের আসল রূপকে এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মূলত এ কবিতার একশো উনিশ লাইনে কবি যেন চিত্রকর হয়ে এঁকে ফেলেছেন রাষ্ট্রের সবগুলো কাঠামো ও তাদের ব্যবহারের মধ্যকার বাস্তবিক চিত্র।

যে দেশের কবিতা নবারুণ এখানে বলেন, সেখানে দেশ বলতে শুধু ভৌগোলিক সীমারেখাকেই বোঝায় না- বোঝায় জনগণের হৃদয়ভূমিকেও। রাজনীতি যে শুধু রাজার নীতি নয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে জনগণের অংশীদারিত্ব রয়েছে, সেটিও উপলব্ধি করা যায়- যখন নবারুণের কলম লিখে ফেলে আরো কয়েকটি লাইন,

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না

এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না

এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না

এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না।

অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

anindetamonti3@gmai.com

শেয়ার করুন