Bangla
a year ago

কীভাবে বিশ্বখ্যাত হলো ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি?

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

সুগন্ধি হলো বিলাসিতার প্রতীক। ঠিক যেন একটি শিল্পকর্মের মতো। তাই তো শিল্পকর্ম, সুগন্ধি, বিলাসিতা এই শব্দগুলো ফ্রান্সের সাথে একই সূত্রে গাঁথা। ফ্রান্সের বিখ্যাত ফ্যাশন হাউজ শ্যানেলের কর্ণধার, কোকো শ্যানেল বলেছেন, “সুগন্ধি ছাড়া কমনীয়তা আনা সম্ভব নয়।”

সুগন্ধি তৈরির শিল্পে শত শত বছর ধরে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে আছে ফ্রান্স। ডিওর, শ্যানেল, গারলেইন, ওয়াইএসএল, হারম্যাজ, ল্যানকাম, ক্লোই, জুভঞ্চি – নামকরা এসব ফ্রেঞ্চ পারফিউম বা সুগন্ধির নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। বড় বড় তারকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরও ফ্রেঞ্চ সুগন্ধিকে ঘিরে এক অদ্ভুত মোহ কাজ করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করল এবং কেন এই সুগন্ধি এত দামী।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর, সিন্ধু ও চীন সভ্যতায় প্রথম সুগন্ধি তৈরি করা হয়েছিল। এরপরে গ্রীক ও রোমানদের দ্বারা সুগন্ধির ব্যবহার প্রচলিত হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে সুগন্ধির ব্যবহার এক প্রকার নেই হয়ে যায়। তবে পশ্চিম ইউরোপে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় সুগন্ধির ব্যবহার শুরু হয়। তখন সৃষ্টিকর্তার প্রতি  ভক্তিস্বরূপ সুগন্ধি ব্যবহৃত হতো।

রেনেসাঁ যুগে ইউরোপে সুগন্ধি শিল্প হিসেবে সমৃদ্ধ হওয়া শুরু করে। তখন শুধু গন্যমান্য ব্যক্তিরাই সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। রাজা দ্বিতীয় হেনরির স্ত্রী ক্যাথরিন ডি মেডিসির পছন্দমতো সুগন্ধি তৈরি করতেন রেনে নামক এক ব্যক্তি। মূলত এই রেনের হাত ধরেই ফ্রান্স দ্রুতই সুগন্ধি তৈরির কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ফ্রেঞ্চ সুগন্ধী বিশ্বখ্যাত হওয়ার পিছনে অবদান রয়েছে ফ্রান্সের প্রভেন্স ও দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রাস নগরীর। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ফ্রান্সে সুগন্ধির চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন গ্রাস শহর সুগন্ধি তৈরির কাঁচামালের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর এই কারণেই গ্রাসকে বলা হয় বিশ্বের সুগন্ধির রাজধানী।

কিন্তু এই শহর একদম শুরু থেকেই সুগন্ধির রাজধানী ছিল না। কীভাবে তা হলো সে কাহিনী জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। দ্বাদশ শতাব্দীতে শহরের আশেপাশের খালগুলোকে কেন্দ্র করে গ্রাসে ট্যানারি শিল্প বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে সেই চামড়ার কারখানা থেকে বাজে গন্ধ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ত।

দুর্গন্ধ এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তা মোকাবেলার জন্য সুগন্ধি তৈরির কারখানা গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় এ শহরের মাটি, পানি ও আবহাওয়া সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত উদ্ভিদ চাষের জন্যে আদর্শ। তাই সপ্তাদশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে গ্রাসে সুগন্ধি শিল্প প্রসার লাভ করতে থাকে। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে সুগন্ধি শিল্প ট্যানারি শিল্পের স্থান দখল করতে লাগলো।

ডিওর, শ্যানেলসহ ফ্রান্সের অন্যান্য বিখ্যাত ফ্যাশন হাউজগুলোর সুগন্ধি এখান থেকেই তৈরি হতে লাগলো। গ্রাসের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জুঁই, গোলাপ, লজ্জাবতী গাছ, ল্যাভেন্ডার, রজনীগন্ধা, কমলা চাষ করা হয়। অনেকেই নিজেদের নাককে প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্যে দুই হাজারের বেশি রকমের ঘ্রাণ আলাদা আলাদাভাবে চিনতে গ্রাসে এসে দিন কাটিয়েছে।

এই ছোট্ট শহরে প্রায় ৫০ হাজারের মতো মানুষ বাস করে। এখানকার ৬০টির বেশি সুগন্ধি কোম্পানিতে স্থানীয় জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ কাজ করছে। শুধু এই শিল্প থেকে গ্রাস শহরের বার্ষিক আয় ৬০০ মিলিয়ন ইউরো। ফলে সেখানকার বাণিজ্য শুল্কের সিংহভাগই আসে সুগন্ধি শিল্পের মাধ্যমে। সেই সাথে একে ঘিরে গ্রাসের পর্যটন খাতও ব্যাপকভাবে লাভের মুখ দেখছে।

ফ্রেঞ্চ সুগন্ধির বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার পেছনে তীব্র ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন মানুষদের অবদান না বললেই নয়। কারণ ঘ্রাণশক্তি সবার সমান নয়। এখনও সুগন্ধি তৈরির জন্যে তীব্র ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। তাই তাদের কাজের দাম ঠিক তেমনই আকাশ ছোঁয়া। মাত্র ৫০ জনের মতো ঘ্রাণ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন ফ্রান্সে। গ্রাসে শত শত বছরের পুরনো বেশ কিছু সুগন্ধি ব্র্যান্ড আজও রয়েছে। যেমন - গালিমার্ড পারফিউমারি, মলিনার্ড ও দ্য ফ্র্যাগোনার্ড পারফিউমারি। 

আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএমএআরসি)-এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী সুগন্ধি বাজারের আকার ২০২৩ সালে ছিল ৩৭.০৬ বিলিয়ন ডলার। ২০৩২ সালের মধ্যে এই বাজারের আকার ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছরে ফ্রান্সের সুগন্ধি বাজার থেকে আয়ের পরিমাণ ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী সুগন্ধি বাজারে ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি শিল্পের অংশ ১৮ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ, বিশ্ববাজারের একটি বড় অংশ ফ্রেঞ্চ সুগন্ধির দখলে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন ফ্রেঞ্চ সুগন্ধির চাহিদা এতো বেশি। এর প্রথম কারণ হলো এতে প্রাকৃতিক উপাদানের নির্যাস থাকে। কৃত্রিম গন্ধের ছোঁয়া এতে তেমন নেই বিধায় এর দামও অনেক বেশি। তাছাড়া ফ্রেঞ্চ সুগন্ধিতে থাকে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি তেলের মিশ্রণ। ফলে এর সুবাস ত্বকে বেশিক্ষণ লেগে থাকে। প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে এই সুগন্ধি তৈরি হয় বলে ত্বকেরও কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

শুধু প্রাকৃতিক উপাদানই নয়, আকর্ষণীয় ও শৈল্পিক প্যাকেজিং এবং নজরকাড়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি করেছে বাজিমাত। সুগন্ধির বোতলগুলোর নকশা অনেক ক্ষেত্রে সোনা বা দামি পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়। এই কারুকাজখচিত নকশা সুগন্ধির মূল্য আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। 

আর বিজ্ঞাপনগুলোতে বিশ্বসেরা মডেল ও তারকাদেরকে উপস্থাপন করা হয়। এর পাশাপাশি বেশিরভাগ ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি ব্র্যান্ডগুলো প্রায় শত বছর কিংবা অর্ধশত বছরের পুরনো। ফলে ব্র্যান্ডগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কারণে সেখানকার পণ্যের দাম হয় অনেক চড়া।

এসবের বাইরেও, কে না চায় বড় বড় তারকাদের মতো এই বিলাসবহুল ফ্রেঞ্চ সুগন্ধির ঘ্রাণ একটু পরোখ করে দেখতে?

m.maliha906@gmail.com

শেয়ার করুন