প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
আদিম মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক বেশি জানার সুযোগ আমরা পাই না। যেটুকুই জানতে পারি তা আমাদের বিস্মিত করে। এমনই এক বিস্ময় জাগানিয়া জাতি ‘রাপা নুই’।
রাপা নুই মূলত পলিনেশিয় জাতি থেকে আগত। প্রশান্ত মহাসাগরে চিলির কূলঘেষা ইস্টার আইল্যান্ডে এই পলিনেশিয়রা তৈরি করে এক হাজারের অধিক মূর্তি। মূর্তিগুলোর অবস্থান, আকৃতি, নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে এখনো নৃতাত্ত্বিকরা চর্চা করেন।
মূর্তিগুলো মোয়াই নামে অধিক পরিচিত। বিশাল দৈত্যাকৃতির মুখাবয়বের জন্য এগুলোকে জায়ান্ট হেডও বলা হয়। এই মূর্তিগুলো তৈরি করা হয়েছিল ১২৫০-১৫০০ সালের মধ্যে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি দ্বীপ ‘ইস্টার আইল্যান্ড’। বর্তমানে চিলির অধীনে থাকা দ্বীপটি ‘রাপা নুই’ নামেও পরিচিত। স্থানীয় মানুষের ভাষায় দ্বীপটির নাম ‘তে পিতো ওতে হনুয়া’ যার অর্থ বিশ্বের নাভিমূল।
প্রায় ৭ লক্ষ বছর আগে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে দ্বীপটির সৃষ্টি হয়েছে। দ্বীপটিতে তিনটি আগ্নেয়গিরি আছে। এগুলো হলো রানো রারাকু, ম্যঙ্গাটেরেভাকা ও কাটিকি।
আধুনিক কালে প্রথম ইউরোপিয় হিসেবে ১৭৭২ সালে দ্বীপটিতে পা রাখেন ডাচ নাবিক অ্যাডমিরাল জ্যাকব রোগেভিন ও তার দল। তারা যেদিন দ্বীপটিতে পা রাখেন সেদিন ছিল ইস্টার সানডে। তাই জ্যাকব দ্বীপটির নাম দেন ইস্টার আইল্যান্ড। দ্বীপটির আয়তন ১৬০ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে লোকবসতি খুবই কম, মাত্র ১৬০০ জনের মতো।
জনবিরল এই দ্বীপের প্রায় পুরোটা জুড়েই দেখা মেলে দৈত্যাকার সব মূর্তির। তবে সম্মুখভাগেই মূর্তির সংখ্যা বেশি। মূর্তিগুলোকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা রহস্য, নানা কাল্পনিক গল্প। এই মূর্তিগুলোর রহস্য উন্মোচনে নৃতাত্ত্বিকরা চেষ্টা করে চলেছেন এখনো।
নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা, মূর্তিগুলো মূলত পলিনেশিয়দের পূর্ব পুরুষদের মুখাবয়ব নিয়ে বানানো। বহু শতাব্দী আগে আগ্নেয়-দ্বীপের বাসিন্দারা পাথর খোদাই করে এই প্রকাণ্ড মুখগুলো তৈরি করেছেন। এই পাথরগুলোও মূলত অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ছাই জমে তৈরি হয়েছে।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল মূর্তিগুলোর কেবল ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত বানানো হয়েছে। কিন্তু ২০১২ সালে কয়েকটি মূর্তির পাশে খনন করে দেখা গেছে মূর্তিগুলোর সম্পূর্ণ শরীর রয়েছে।
মূর্তিগুলোর উচ্চতা ৩ ফুট থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত। এদের মধ্যে কিছু ভেঙে গেছে, কিছু মূর্তি অর্ধসমাপ্ত। কোনো এক অজানা কারণে দ্বীপের বাসিন্দারা মূর্তিগুলো সম্পূর্ণ করতে পারেননি। দ্বীপের ভেতরের মূর্তিগুলো ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় দেখা গেলেও সমুদ্রতটের মূর্তিগুলো কালের প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মোয়াই নামের মূর্তিগুলোর অদ্ভুত চেহারার কারণে অন্য যেকোনো মূর্তি থেকে এদের আলাদা করা যায় সহজে। লম্বা নাক, চওড়া থুতনি, চারকোনা কান, উঁচু ভ্রু ও গভীর চোখের কুঠুরি এদেরকে অন্য মূর্তি থেকে স্বকীয়তা দেয়। কিছু কিছু মোয়াইয়ের মাথায় ‘পুকাও’ নামে টুপির মতো একটি বিশেষ অংশ দেখা যায়।
মোয়াইগুলো মূলত এই দ্বীপের বাসিন্দাদের মৃত সৎকারের অংশ। অনেকগুলো মোয়াইকে পাশাপাশি স্থাপন করা হতো স্মৃতিস্তম্ভের মতো। এ ধরনের স্মৃতিস্তম্ভের স্থানীয় প্রাচীন নাম ‘আহু’। বেশিরভাগ আহুর মোয়াইগুলো দ্বীপের দিকে মুখ করে স্থাপন করা। কেবল সম্মুখভাগের একটি আহুর মোয়াই সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসানো।
দ্বীপে থাকা সবগুলো মোয়াই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল টুকুটুরি নামে একটি মোয়াই হাঁটু গেড়ে বসে আছে আকৃতির। অনেকে মনে করেন মৃতের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যেই দ্বীপের প্রাচীন আদিবাসীরা এই দানবীয় মূর্তিগুলো তৈরি করেছিল।
গবেষকদের মতে মোয়াইগুলো ইস্টার আইল্যান্ডের এক প্রান্তে থাকা রানো রারাকু নামের আগ্নেয়গিরির আশেপাশে বানানো হয়েছে। এই আগ্নেয়গিরির আশেপাশে প্রায় ৪০০টি অসম্পূর্ণ মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু মোয়াইগুলো স্থাপন করা হয়েছে সমগ্র দ্বীপজুড়েই। রানো রারাকুর আশেপাশে অনেকগুলো ভাঙা মোয়াই পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এগুলো পরিবহনের সময় ভেঙে গিয়েছে।
ভগ্নাংশগুলোর অবস্থা থেকে ধারণা করা হয় মোয়াইগুলোকে খাড়া করে স্থানান্তর করা হয়েছে। ইস্টার আইল্যান্ডের বাসিন্দারা কিভাবে এতো বড় ও ভারী মোয়াইগুলো খাড়া করে পরিবহন করতো তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি গবেষকরা।
চিলির মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দূরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার পর্যটক আসে। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে বিমানযোগে এই দ্বীপে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘন্টা।
১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো দ্বীপটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে।