খালিস্তান: শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী যে আন্দোলন ভারতকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিকে পুনরুজ্জীবিত করা এক শিখকে ধরতে ভারতের পাঞ্জাবজুড়ে পুলিশের বিশাল বহরের তল্লাশি অভিযান রাজ্যটিতে সহিংসতার আশঙ্কা উসকে দেওয়ার পাশাপাশি হাজারও মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া রক্তাক্ত এক বিদ্রোহের বেদনাদায়ক স্মৃতিকেও ফিরিয়ে আনছে।
হত্যাচেষ্টা, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে বাধা দেওয়া, সমাজের ‘সম্প্রীতি বিনষ্টের’ অভিযোগে ৩০ বছর বয়সী অমৃতপাল সিংকে শনিবার থেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ; যাকে বলা হচ্ছে ভারতের সংখ্যালঘু শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য সার্বভৌম খালিস্তান রাষ্ট্র চাওয়া নিষিদ্ধঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি।
ভিডিও ফুটেজে শত শত সমর্থককে অমৃতপালের মুক্তির দাবিতে মিছিল করতে দেখা যাচ্ছে, এদের কারও কারও হাতে আছে তলোয়ার ও লাঠি। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে রাজ্যটির অনেকগুলো জেলায় সশস্ত্র পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
এখন পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে, ‘সহিংসতায় প্ররোচনা রুখতে’ কর্তৃপক্ষ পুরো রাজ্যের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছে; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে একসঙ্গে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য এমন ‘বিস্তৃত ব্ল্যাকআউটের’ ঘটনা আর দেখা যায়নি।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে অমৃতপালকে ধরতে চলা অভিযানের খবরই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল কিছুক্ষণ পরপর দিচ্ছে আপডেট।
জনপরিসরে অমৃতপাল সিংয়ের এমন দ্রুতগতির উত্থান খালিস্তান আন্দোলনকে আবার মানুষজনের মনোজগতে নিয়ে এসেছে, সহিংসতার ভয় বাড়ছে সেই রাজ্যে, যেটি দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে।
কে এই অমৃতপাল সিং?
গত বছর অভিনেতা ও অ্যাক্টিভিস্ট দীপ সিধু মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিতর্কিত ও স্বঘোষিত ধর্মপ্রচারক অমৃতপাল তুলনামূলক অচেনাই ছিলেন।
সিধু দেশটিতে বছরখানেকেরও বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন, শিখদের অধিকার রক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’ নামের একটি সংগঠন।
এই সংগঠনটি নরেন্দ্র মোদীর কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের কৃষক ও অ্যাক্টিভিস্টদের সংগঠিত করা শুরু করে; এই কৃষক ও অ্যাক্টিভিস্টদের অধিকাংশই ছিল শিখ।
দেশজুড়ে কৃষকদের তীব্র আন্দোলনের মধ্যে মোদী ২০২১ সালের নভেম্বরে তার কৃষি সংস্কার আইন নিয়ে পিছু হটলেও ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’- কার্যক্রম বন্ধ হয়নি, তারা শিখ ধর্ম ও পাঞ্জাবের সংস্কৃতি রক্ষায় প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় সিধু মারা গেলে সংগঠনের নেতৃত্ব চলে যায় অমৃতপাল সিংহের হাতে। একের পর এক কর্মসূচিতে তার গরম গরম বক্তৃতা তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে, গড়ে ওঠে বিশাল ভক্তকূলও।
মোদী নেতৃত্বাধীন ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী অপতৎপরতার’ বিরুদ্ধে শিখদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা ও নানান সামাজিক ইস্যুতে তার মন্তব্য পাঞ্জাবের অনেক শিখকে তাঁতিয়ে তোলে।
অমৃতপালের সঙ্গে তুলনা চলছে জার্নাইল সিং ভিনদ্রানওয়ালের সঙ্গে, যিনি ছিলেন খালিস্তান আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে শিখদের পবিত্র মন্দির অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভিনদ্রানওয়ালকে হত্যা করেছিল।
সেনাবাহিনীর ওই অভিযান পুরো শিখ সম্প্রদায়কে এতটাই ক্রুদ্ধ করেছিল যে এমনকী ইন্দিরা গান্ধীকেও তার শিখ দেহরক্ষীর হাতে মরতে হয়।
গত মাসে অমৃতপালও এক বক্তব্যে ভিনদ্রানয়ালের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ খালিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে বলার পর অমৃতপাল তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, অমিত শাহেরও ইন্দিরা গান্ধীর পরিণতি বরণ করা লাগতে পারে।
অমৃতপালের বাবা তারসিম সিং চলতি সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেছেন, তার ছেলেকে ধরতে যে অভিযান চলছে তা ‘ষড়যন্ত্র’, আর তার ছেলে মূলত মাদকাসক্তির বিরুদ্ধেই লড়ছে।
খালিস্তান আন্দোলন কী?
পঞ্চদশ শতকে গুরু নানক পাঞ্জাবে শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বজুড়ে এখনও এর প্রায় আড়াই কোটি অনুসারী আছে।
ভারতে শিখরা সংখ্যালঘু; দেশটির জনসংখ্যার অনুপাতে এই সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম। কিন্তু পাঞ্জাবে আবার তার সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আধুনিক খালিস্তান আন্দোলনের উৎস পাওয়া যায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কালে। সেসময় অনেক শিখই পাঞ্জাবকে ঘিরে শিখ ধর্মের অনুসারীদের জন্য একটি দেশ দাবি করেছিলেন।
ভারত শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা পেল; দেশ হল দুটি, তাও ধর্মের ভিত্তিতেই। মুসলমানরা পেল নবগঠিত পাকিস্তান, আর হিন্দু আর শিখতের বরাতে জুটল স্বাধীন ভারত।
ওই দেশভাগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দাঙ্গা আনুমানিক ১০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল; ৯০ লাখ মুসলমান এবং ৫০ লাখ হিন্দু ও শিখকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছিল।
দু-টুকরো হওয়া পাঞ্জাব সেসময় রক্তাক্ত সব সহিংসতার সাক্ষী হয়েছিল। ওই সময় থেকেই শিখরা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই শুরু করে, যার সূত্র ধরেই খালিস্তান আন্দোলন দৃঢ় ভিত্তি পায়।
এরপর এই আন্দোলনের অনুসারীদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাদের অনেকবার সংঘর্ষ হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে।
“পাঞ্জাবে ধর্ম ও আঞ্চলিকতা এক হয়ে যায়। খালিস্তান আন্দোলনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল আঞ্চলিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ধারাবাহিক হস্তক্ষেপও,” বলেছেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আশুতোষ কুমার।
কিন্তু ১৯৮৪ সালে স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনার হানা সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়; ওই দিনটির স্মৃতি ভারত ও ভারতের বাইরে শিখদের এখনও তাঁতিয়ে দেয়।
ওই দশকেই পাঞ্জাবের অনেক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীই বেসামরিক হত্যা, নির্বিচারে বোমা হামলা, সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলাসহ একের পর এক মানবাধিকার লংঘন করেছে বলে জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
অবশ্য কেবল তারাই নয়, বিদ্রোহ দমনের নামে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরাও ‘লাখ লাখ শিখের’ ওপর চালিয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন, করেছে অসংখ্য মানবাধিকার লংঘন, বলছে মানবাধিকার সংগঠনটি।
তবে খালিস্তানের সমর্থকরা এখন পাঞ্জাবে ‘অত্যন্ত নগণ্য’ এবং খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই মনে করছেন আশুতোষ কুমার।
“পাঞ্জাবের শিখরা জানে, যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ফিরে আসে তাহলে তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে,” বলেছেন তিনি।
ভারতের বেআইনি কর্মকাণ্ড (প্রতিরোধ) আইনে খালিস্তান আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য সংগঠনকে ঢোকানো হয় ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তালিকায়।
কিন্তু বিদেশে খালিস্তানের সমর্থকরা অবাধে চলাচল করতে পারছে। কানাডা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় শিখদের অনেকের কাছে এই আন্দোলন সমর্থনও পাচ্ছে।
অমৃতপালের সমর্থকরা এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় কনস্যুলেটে তাণ্ডব চালিয়েছে, ভারতের জাতীয় পতাকা নামিয়ে, সেখানে খালিস্তানের প্রতীক বসিয়ে দিয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে কানাডাতেও।
“সম্ভবত বাইরে এর পক্ষে সমর্থন বেশি, কারণ প্রবাসীরা তাদের শেকড় খুঁজছে। দশকের পর দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকার পাঞ্জাবের শিখদের দমিয়ে রেখেছে। তাই প্রবাসীরাদের মধ্যে খালিস্তানকে সমর্থনের মাধ্যমে তারা পাঞ্জাবে তাদের ভাইদের সমর্থন দিচ্ছে, এমন ভাবনাও খেলতে পারে,” বলেছেন আশুতোষ।
অমৃতপাল সিং কোথায় এখন?
অধরা অমৃতপালকে ধরতে পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে, হাজার হাজারে সেনাকে মোতায়েন করা হয়েছে। দ্রুতই তাকে ধরা হবে এমন আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে।
সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া একটি সাদা গাড়ির ছবি সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছে, ওই গাড়িতে করেই অমৃতপাল একটি টোল বুথ অতিক্রম করেছেন বলে দাবি করছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে এখনও ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’-র ওই নেতার কোনো খোঁজ মেলেনি।
পুলিশ তাকে ‘পলাতক’ অ্যাখ্যা দিয়েছে, দাড়ি ও পাগড়িসহ এবং ছাড়া তার আলাদা আলাদা ছবি প্রকাশ করে তাকে ধরতে জনসাধারণের সহায়তাও চেয়েছে তারা।
এদিকে ‘ওয়ারিস পঞ্জাব দে’-র পক্ষ থেকে পাঞ্জাব হাই কোর্টে পুলিশ অমৃতপালকে অবৈধভাবে আটকে রেখেছে জানিয়ে একটি আবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে।
অমৃতপালের পালানোর ঘটনায় পাঞ্জাব হাই কোর্ট ভর্ৎসনার সুরে বলেছে, “৮০ হাজার পুলিশ কর্মী ছিলেন, তার মধ্যে তিনি পালিয়েছেন। স্পষ্টতই এটা গোয়েন্দা ব্যর্থতা।”