কিশোরগঞ্জের তিন ঐতিহ্যবাহী খাবার: চ্যাপা পুলি, কলাপিঠা ও নকশি পিঠা
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে খাবারের বৈচিত্র্যতায় অন্যতম একটি নাম কিশোরগঞ্জ। এখানকার বেশকিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য অংশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমনই কয়েকটি নাম নাম হচ্ছে চ্যাপা পুলি, কলাপিঠা ও নকশি পিঠা।
চ্যাপা পুলি
চ্যাপা পুলি নাম নিলেই স্থানীয়দের জিভে জল চলে আসে। আর যে একবার খেয়েছে তার পক্ষে এর স্বাদ ভোলা সম্ভব না। এই খাবারের মূল উপাদান হচ্ছে চ্যাপা আর কুমড়া পাতা।
মাঝারি সাইজের পুঁটি মাছ, বাঁশপাতা মাছ আরো নানা ধরনের ছোট মাছকে তেল ও লবন দিয়ে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় চ্যাপা তৈরি করা হয়। বাজারে এর চাহিদা অনেক।
চ্যাপা পুলি বানাতে লাগে সয়াবিন তেল, পেয়াজ, হলুদ, কাচা মরিচ, লবন, ধনিয়া, জিরাগুড়া এবং দুই প্রধান উপকরণ চ্যাপা এবং কুমড়া পাতা। তবে এক্ষেত্রে কচি কুমড়া পাতা হলে ভালো হয়।
প্রথমে চ্যাপা ভালো করে ধুয়ে পেয়াজ, মরিচ, লবন, হলুদসহ সব মশলা ও তেল দিয়ে কষাতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে অল্প পানিও দেয়া যেতে পারে। ভালো করে কষানো হলে চুলা থেকে উঠিয়ে রাখতে হয়। এসময় চ্যাপাগুলো ঝুরি ঝুরি হয়ে যায়।
তারপর কুমড়া পাতা ধুয়ে দু-তিনটা পাতা একসাথে করে মাঝখানে প্রয়োজনমত কষিয়ে রাখা চ্যাপা দিয়ে পুলির মতো করে সুতা দিয়ে বেধে দিতে হয়। এভাবে পুলি তৈরি করে কড়াইয়ে হালকা তেল দিয়ে মাঝারি আঁচে পুলি রান্না করতে হয়। সিদ্ধ হয়ে গেলে চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে ভেজে ফেললেই প্রস্তুত হয়ে যায় ঐতিহ্যাবাহী চ্যাপা পুলি।
গরম গরম ভাতের সাথে চ্যাপা পুলি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষের পাতে পরিবেশিত হচ্ছে। তবে কিশোরগঞ্জ ছাড়াও ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নেত্রকোনা অঞ্চলেও বর্তমানে এই খাবার প্রচলিত রয়েছে।
কলা পিঠা
শীতের হাওয়া বইছে। ইতোমধ্যেই কিশোরগঞ্জের ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। তবে এই পিঠা বানানোর তালিকায় সবচেয়ে উপরে যেই পিঠাটি থাকবে সেটি হচ্ছে কলা পিঠা। শীতকাল আসলেই অন্যান্য পিঠার পাশাপাশি এই পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়।
কলা পিঠার নাম শুনেই বোঝা যায় কলা দিয়ে তৈরি। তবে যে সে কলা নয়, হতে হবে বিশেষ এক ধরনের কলা। স্থানীয়রা এই কলাকে বলে বুতিয়া কলা, বিচিসহ মোটা এক ধরনের কলা। খেতে অন্যান্য কলার তুলনায় অনেক মিষ্টি। এর সাথে লাগে চালের গুড়া, গুড় আর অল্প পরিমাণ চুন।
প্রথমে কলাগুলোকে অল্প পানি দিয়ে ভালোভাবে চটকাতে হয়। তারপর অল্প চুন দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয় প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘন্টা। ভিজিয়ে রাখার পর আরো পানি দিয়ে সিদ্ধ করে করে নিতে হয়। সিদ্ধ হওয়ায় পর রসটা ছেকে অন্য একটি পাত্রে নিয়ে গুড় দিয়ে জাল দিতে হয় বেশ কিচ্ছুক্ষন।
এদিকে আতব চাল ৪/৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে তারপর মিহি করে গুড়া করে নিতে হয়। রসের হাড়ি থেকে অল্প অল্প রস নিয়ে চালের গুড়ার সাথে মিক্স করে কাই তৈরি করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হয় কাইটা যেন বেশি নরম বা শক্ত না হয়। কাই করার সময় পরিমাণ মতো লবণ দিতে হয়। তারপর হাতে বানানো সেমাই এর মত মাঝারি সাইজের পিঠা বানিয়ে ঘন রসে দিয়ে কিছুক্ষন মাঝারি আঁচে রান্না করলেই প্রস্তুত কলা পিঠা।
সাধারনত এই পিঠা রাতের বেলায় বানানো হয়। রাত ভর রেখে দেয়া হয় ঠান্ডা হওয়ার জন্য। তারপর কুয়াশাঘন ভোরে জমে থাকা কলা পিঠা দিয়েই দিনের শুরু করেন কিশোরগঞ্জের মানুষেররা।
নকশি পিঠা বা পাক্কন পিঠা
স্থানীয় মানুষের মাঝে প্রচলিত রীতি হলো এই পিঠা অনেকে মিলে বানাতে হয়। বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় এই পিঠা বানাতে। কিন্তু ঝক্কি ঝামেলায়ও কদর কমেনি এই পিঠার।
পিঠা বানাতে প্রথমেই প্রয়োজন আতপ চালের গুড়া। তারপর হালকা গরম পানি দিয়ে কাই করে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কাই বেশি নরম বা শক্ত না হয়। কাই ঠিক না হলে পিঠা ফেটে যায়।
তারপর বড় বড় করে রুটি বানিয়ে গোল ছাচে কাটা হয়। এরপরই শুরু হয় আসল কাজ। একেক জন একেক ভাবে তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে তৈরি করেন নকশা। নকশা তৈরিতে খেজুরের কাটা, সুঁই ব্যাবহৃত হয়। ফুল, লতা পাতা, পালকি, নৌকা, পাখি - কী নেই নকশায়।
নকশাগুলোর থাকে ভিন্ন ভিন্ন নাম। কন্যামুখ, জামাইমুখ, জামাইমুচড়া, সতীমুচরা, শঙ্খলতা, কাজললতা পদ্মদীঘি, সাগরদীঘি, চিরলপাতা, হিজলপাতা, বেঁট ফুল, আরো অনেক নাম দেয়া হয়।
নানা ধরনের নকশা করে পিঠা বানানোর পর তেলে ভাজা হয়। কখনো আবার ভাজার পূর্বে পিঠাগুলো রোদে শুকানো হয়। তেলে ভাজার পর সাথে সাথেই গুড়ের রসে ভেজানো হয়। এভাবেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী নকশী পিঠা বা পাক্কন পিঠা।
nawshinmushtary38@gmail.com