প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
‘দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে’
নিজের প্রতিভার ওপর ভরসা ছিলো তাঁর। হয়তো সে কারণেই এ সমাধি লিপি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেই লিখে গেছেন। অমর কবি জানতেন তাঁর সৃষ্টিই তাঁকে অমরত্ব দেবে পাঠকের কাছে। মৃত্যুর পনেরো বছর পর তাঁর সমাধিক্ষেত্রে এই লিপি উৎকীর্ণ হয়।
আজন্ম বিদ্রোহী, খেয়ালি সৃজনী প্রতিভার আরেক নাম মাইকেল মধুসুদন দত্ত। ২০১ বছর আগে ভরা শীতের মাঘ মাসে (জানুয়ারি ২৫, ১৮২৪ খ্রি) জন্মগ্রহণ করেন কবি। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত এবং মাতা জাহ্নবী দেবীর সন্তান মধুসূদনের সাত বছর বয়স পর্যন্ত সাগরদাঁড়ি গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা চলে। এরপর কলকাতার খিদিরপুরে এসে সেখানে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানকার পাঠ শেষ করে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজে আসেন মাইকেল। হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক ডিরোজিও প্রভাবিত ইয়ং বেঙ্গলদের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন যুবক মধুসূদন। বরাবরই ভীষণ বেহিসেবি তিনি । উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশ ছোঁয়া-- অর্থ ব্যয়ে এবং জীবনযাপনেও হিসেবের ধার ধারতেন না মোটেও। মহাকবি হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তাঁর। ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃতসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বিলেতে গিয়ে বড় কবি হবেন এই স্বপ্নকে ধারণ করেই পারিপার্শ্বিক বন্ধন ছিন্ন করে এগুতে থাকেন। ইংরেজি ভাষার বড় কবি হওয়ার বাসনায় দেশ ত্যাগ করেন, ধর্মান্তরিতও হন। জীবনের শুরুতে নিজ সংস্কৃতিকেও অবহেলা করেছেন নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদে।
১৮৪৩ সালে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহন করেন। পরে নামের সঙ্গে ‘মাইকেল’ যুক্ত হয়। এসব কারণে পিতার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। এসময় হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি শিবপুর বিশপ কলেজে ভর্তি হন। কয়েক বছর পর ১৮৪৮ সালে কবি ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজ যান। মাদ্রাজে অবস্থানকালে ‘Madras Circulator’ পত্রিকায় ‘Timothy penpoem’ ছদ্মনামে ‘Visions of the past' ও 'The Captive Lady’ গ্রন্থদুটি রচনা করেন।
মাতৃভাষাতেই সাহিত্য রচনায় সার্থকতার প্রাপ্তিযোগ ঘটতে পারে, এই উপলব্ধি তখনই ঘটে কবির। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এসে বাংলাভাষাকে ভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে ব্যবহার করে লেখেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা, ‘পদ্মাবতী’, ’কৃষ্ণকুমারী’ । কাব্য রচনার ঐশ্বরযময় যাত্রার শুরু হয় এখানেই। ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ‘চর্তুদশপদী কবিতাবলী’র মতো কাব্য রচনা করে সমৃদ্ধ করেন বাঙলা সাহিত্যকে। ‘হেক্টর বধ’, ‘মায়াকানন’ কাব্যনাটকগুলো কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। মাইকেলের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামক প্রহসন দুটো বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন। সংস্কৃত নাটক ‘রত্নাবলী’ ও দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজি অনুবাদও করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
কবি ১৮৬২ তে ইংল্যান্ডে যান ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে ফ্রান্সে গমন করেন। ফান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে বেশ কিছু সনেট লেখেন। তার মধ্যে ‘কপোতাক্ষ নদ’ ও‘বঙ্গভাষা’ অন্যতম।
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যার হাতে সার্থক যাত্রা শুরুর স্বস্তি পেলো, তিনিই ব্যক্তিজীবনে খুব স্বস্তিতে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেননি। কবির ব্যক্তিজীবনের লেখচিত্র বিচিত্র মাত্রায় ওঠানামা করেছে শুরু থেকে শেষ অবধি।১৮৬৭ তে মাইকেল কলকাতায় ফেরেন। তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের তুলনাহীন ঐশ্বর্যে সাহিত্যভান্ডার তখন ভরপুর। কিন্তু বড়ো কঠিন সেই বাস্তবতা! মাইকেল ও তাঁর পরিবার তখন চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি। অর্থাভাব এবং রোগশোকের আঘাতে অমিত প্রতিভার মধুকবির জীবন আয়ু ক্রমেই শেষ হয়ে আসছিলো। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন কলকাতার আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে মাইকেল মধুসুদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দুই.
মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে ভেসে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগ্রত বাঙালি তরুণ যে প্রথাগত সংস্কারের বিরুদ্ধে ভীষণ দ্রোহী। তাঁর জীবনভাবনা ও জীবনবোধ এবং শিল্পসৃষ্টির অভিপ্রায় সবই সমকালের প্রচলিত ও জনপ্রিয় পথকে অনুসরণ করে এগোয়নি। বরং আপন মনের তাগিদে এগিয়ে গেছেন এই স্বভাবদ্রোহী শিল্পী। মাত্র উনপঞ্চাশ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবন তাঁর। তবুও এক নতুন পথ সৃষ্টির তৃষ্ণায় ব্যাকুল মধুসুদন দত্ত সঙ্কুল জীবনযাত্রাকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছেন তীব্র ঝোঁকে। সে যাত্রা খুব নির্বিঘ্ন ছিলো না। আবেগের তীব্রতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বপ্নে বিভোর কবি তবুও থেমে যাননি, আপোষ করেননি। সাহিত্যে সমস্ত পুরনো ধারা ও শৈলীকে ভেঙে দিয়েছেন সাহসী কবি। অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করে তার পরিমিত বুননে গেঁথে তুলেছেন অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। এমনিভাবে নিজ প্রজ্ঞা ও প্রতিভার সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বহু নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন মধুকবি।
যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কপোতাক্ষ নদ খ্যাতি পেয়েছে মহাকবির জন্য। মধুকবি প্যারিসের শিন নদীর পাড়ে বসে ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি লিখেছিলেন। শিন নদীর রূপে কবির মন ভরেনি। শৈশবের সেই কপোতাক্ষের স্বচ্ছ জলধারার বয়ে চলার ছন্দ আর তৃষ্ণা নিবারিত হওয়ার স্মৃতি কবি বয়ে চলেছেন আজীবন। অতীতার্ত কবির নাগরিক মন এভাবেই স্বদেশকে অনুভব করে চৌদ্দ মাত্রায়, চৌদ্দ চরণে:”‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;/…... কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/…...আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে,...’
বিদেশ বিভুঁইয়ে অবস্থানকালে শৈশবস্মৃতি বিজরিত সাগরদাঁড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাস প্রকাশ পেয়েছে সনেটটিতে। প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোহে যৌবনে কবি স্বভূমি ত্যাগ করে বিদেশে অবস্থান করেছেন। এসবই ভ্রান্তির ছলনা, যা কবিকে ভুলিয়ে রেখেছিলো। মোহের আবেগ উবে গেলে কবি জন্মভূমির প্রতি গভীর টান অনুভব করেছেন। জন্মভূমি ও এর প্রকৃতি, চারপাশের কৃষ্টি-কালচার এবং মাতৃভাষার প্রতি আবেগ এক অদৃশ্য গভীর ও অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তির সঙ্গে। সময় যত গড়ায় এই আবেগ তত বেশি সঞ্চারিত হতে থাকে। মাইকেল মধুসূদনের কবিজীবন এবং ব্যক্তিজীবনেও তা সুস্পষ্ট।
‘রেখো মা দাসেরে মনে এ মিনতি করি পদে/সাধিতে মনের সাধ ঘটে যদি পরমাদ/
মধুহীন কোরনাগো তব মন কোকনদে।’ (বঙ্গভূমি)
কবির এই আক্ষেপ ও আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন ঘটেছে সর্বাংশে। শিল্পসাহিত্যকে নতুনভাবে দেখার এবং নতুনভাবে সৃষ্টির স্বতঃউৎসারিত প্রেরণাই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে একুশ শতকের পাঠকের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
ড. রওনক জাহান, সরকারি তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ-এর বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
rownakbabu21@gmail.com