প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
'পিঠা' শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত 'পিষ্টক' শব্দ থেকে। আবার পিষ্টক এসেছে ‘পিষ্' ক্রিয়ামূলে উৎপন্ন শব্দ ‘পিষ্ট' থেকে, যার অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত কিংবা দলিত৷ বাঙালি ঐতিহ্যের এক অন্যতম ধারক এবং বাহকের নাম পিঠা। হেমন্তের নবান্নের পর শীতের শুরু থেকেই ঘরে ঘরে যেন পিঠা বানানোর ধুম লেগে যায়।
ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, নকশি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পাকন মিঠা, মেরা পিঠা, তাল চাপড়ি, সেমাই পিঠা, জামাই পিঠা, পানতোয়া, মালপোয়া আরও কত কী নাম তাদের!
কিছু পিঠা যেমন সব অঞ্চলেই জনপ্রিয়, ঠিক তেমনি কিছু পিঠা আবার এলাকাভিত্তিক রাজত্ব বিস্তার করেছে যুগ যুগ ধরে। প্রতিটি অঞ্চলের পিঠাই তার নিজস্ব লোক-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। বই-পত্র ঘেটে প্রায় শতাধিক পিঠার পরিচয় পাওয়া যায়, যার উৎপত্তি এই বঙ্গীয়দেশ।
'কাল ধানের ধলা পিঠা,
মা’র চেয়ে মাসি মিঠা।'
-খনা
নকশি পিঠা
এই পিঠার নাম যেমন সুন্দর, এটি দেখতেও তেমনি সুন্দর। ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয় বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায় এর উৎপত্তি। মেঘনা নদীর পাড়ে নরসিংদীর কোনো এক গ্রামে চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা হতো আল্পনা। সেই আল্পনা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এক নারী চালের গুড়ির মণ্ড বানিয়ে তাতে খেজুর কাঁটা দিয়ে নানারকম নকশা বানিয়ে পিঠার রূপ দেন।
কালক্রমে সেই পিঠা তার গ্রাম ছাড়িয়ে সমস্ত বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং খ্যাতি পায় নকশি পিঠা নামে। নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে নকশী পিঠা বেশ জনপ্রিয় ছিল বলে জানা যায়। আতপ চালের গুঁড়া সেদ্ধ করে বিভিন্ন ছাঁচে বসিয়ে এটি বানানো হয়ে থাকে।
জামাই পিঠা
এক সময় এদেশের গ্রামীণ বিয়েতে কনের বাড়ি থেকে ডালাভর্তি পিঠা পাঠানো হতো জামাই এর বাড়িতে। পিঠার ডালার সাথে থাকতো কনের ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন এবং আরও অনেকে। খুব সম্ভবত সেখান থেকেই এক বিশেষ প্রকার পিঠা পরিচিত হয়ে ওঠে জামাই পিঠা হিসেবে।
এর ফুলেল আকৃতির কারণে একে ফুলঝুরি পিঠা হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে কিছু এলাকায়। ময়দা, ডিম, লবণ, তেল এবং ফুলের সাঁচ দিয়ে খুব সহজেই তৈরী করা যায় দৃষ্টিনন্দন এই পিঠা।
মেরা পিঠা
সিলেট এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ও এদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে বিশেষভাবে জনপ্রিয় এটি। চালের গুড়া, লবণ, চিনি, নারকেল, প্রভৃতি উপকরণের সাহায্যে তৈরী এই শীতকালীন পিঠাটি বিভিন্ন প্রকার ভর্তা কিংবা গুঁড় বা মাংসের সাথে পরিবেশন করা হয়। নোনতা স্বাদের এই পিঠাকে অঞ্চলভেদে দৌল্লা পিঠা, গোটা পিঠা কিংবা ভাপা ছান্নাই নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
তাল চাপড়ি
অধিকাংশ পিঠা শীতে জনপ্রিয় হলেও এই পিঠার বিশেষত্ব হলো এটি বানানো হয়ে থাকে শরৎকালে। ভাদ্র মাসের গরমে যখন তাল পেকে চারিদিকে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তখন গ্রামের বাড়িগুলোতে শুরু হয় তালের পিঠা বানানোর উৎসব।
পাকা তাল, আঁখের গুঁড়, চালের গুঁড়া, লবণ এবং কলাপাতা দিয়ে প্রস্তুত করা হয় মুখরোচক তাল চাপড়ি। পাকা তাল থেকে রস আহরণ করা একটি কষ্টসাধ্য কাজ বিধায় তাল চাপড়ি পিঠা বানানো তুলনামূলক কঠিন।
চিনিস পিঠা
মজার ব্যাপার হলো গ্রাম বাংলায় পরিচিত চিনিস পিঠার আসল নাম সিরিঞ্জ পিঠা। কিন্তু সিরিঞ্জ শব্দটি উচ্চারণে কঠিন হওয়ায় লোকমুখে তা বিকৃত হতে হতে চিনিস পিঠা নামে পরিচিতি লাভ করে। মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জনপ্রিয় এই পিঠাটি বানাতে প্রথমে সিদ্ধ চাল পানিতে ভিজিয়ে নরম করে সেটি বেটে সিরিঞ্জের মাধ্যমে কলাপাতার ওপরে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপ দেওয়া হয়।
আতিক্কা পিঠা
আতিক্কা শব্দের অর্থ 'হঠাৎ'। বাড়িতে হঠাৎ যদি কোনো মেহমান চলে আসে তাহলে দ্রুত বানিয়ে দেওয়া যায় এমন এক পিঠা হচ্ছে এই আতিক্কা পিঠা; বা লোকমুখে কলা পিঠা হিসেবেও পরিচিত। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এই পিঠা প্রস্তুত করতে প্রয়োজন বিন্নি চাল, নারিকেল কুচি, চিনি, পাকা কলা এবং কলা পাতা। স্থানীয় ভাষায় একে ডাকা হয় হাফাইন্না পিঠা কিংবা গোইজ্জা পিঠা।
সেমাই পিঠা
শীতের দিনে খেজুর গুঁড় দিয়ে বানানো অত্যন্ত সুস্বাদু এই পিঠা খুলনা-বাগেরহাট এলাকার ঐতিহ্য। দেখতে অনেকটা সেমাই এর মত হয় বলে অধিকাংশ অঞ্চলে এটি সেমাই পিঠা হিসেবেই পরিচিত; যদিও ছুই পিঠা, চুষি পিঠা, চুই পিঠা শিয়াই পিঠা ইত্যাদি নানা নাম রয়েছে তার। সেমাই পিঠা তৈরীতে প্রয়োজন গুঁড়, দুধ, চালের গুঁড়া, লবণ, পানি, কিসমিস, পেস্তা বাদাম ইত্যাদি।
এক সময় বাগেরহাট অঞ্চলে শীতের শুরুতে নবান্ন উতসবের পরপর নতুন জামাই বাড়িতে এলে তাকে সেমাই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। কালের পরিক্রমায় সেমাই পিঠা এখন সমগ্র বাংলাদেশেই শীতকালীন একটি জনপ্রিয় পিঠায় পরিণত হয়েছে।
খোলাজা পিঠা
নোয়াখালি ও ফেনী অঞ্চের বিখ্যাত পিঠা খোলাজা পিঠার নামকরণ হয়েছে এর প্রস্ততপ্রণালিতে ব্যবহৃত মাটির খোলা থেকে। ঢেঁকিছাটা চালের গুঁড়া, লবণ, পানি, ডিম, প্রভৃতি উপকরণে তৈরী হয়ে থাকে খোলাজা পিঠা। এর উপরে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, তবে দেখতে এবং খেতে অনেকটাই রুটির মত তাই সাধারণত বিভিন্ন খাবারের ঝোলের সাথে একে পরিবেশন করা হয়।
পাটিসাপটা
এদেশের বিখ্যাত পিঠাগুলোর নাম আসলে শুরুর দিকেই জায়গা করে নেবে এই পিঠার নাম। ক্ষীরে ভরপুর পাটিসাপটা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজ্যে ভীষণ জনপ্রিয়। ষোল শতকের শেষের দিকে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চন্ডিকাব্যে এই পিঠার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখান থেকে ধারণা করা যেতে পারে এর উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। চিনি, দুধ, ক্ষীর, নারিকেল, ময়দা, চালের গুঁড়া, ইত্যাদি উপকরণের সাহায্যে প্রস্তুত করা হয় পাটিসাপটা।
পিঠা-পুলি বাঙালি জাতির জাতিসত্ত্বার সাথে একান্তভাবে মিশে আছে। গ্রাম-বাংলার বহু নাম না জানা পিঠা আমাদের সংস্কৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ তাদের সাথে নিয়ে হারিয়ে গেছে। অঞ্চলভেদে হরেক রকমের পিঠার উৎপত্তি, তাদের ইতিহাস, তাদের সাথে জুড়ে থাকা লোকজ কাহিনী প্রভৃতি সংরক্ষণ করা জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। তাই আমরা যেন কেবল পিঠা খেয়েই সন্তুষ্ট না হই, বরং পিঠার কারিগরদেরও তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং খ্যাতিটুকু বুঝিয়ে দেই।
khanpushpita11@gmail.com