
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :

১৯৭০ এর দশকের শুরু। আমেরিকার মানসিক হাসপাতালগুলোর বদ্ধ ঘরে অগণিত রোগী। কিন্তু স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ডেভিড রোজেনহানের মনে একদিন এমন একটি প্রশ্নের উদয় হল, যা পুরো মনোরোগবিদ্যাকে নাড়িয়ে দিয়েছে, “একজন মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি আর একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে কি সত্যিই আলাদা করে বোঝা যায়?”
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি এক অভিনব ও বিতর্কিত মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করেন যা ইতিহাসে বিখ্যাত হয় দ্যা রোজেনহান এক্সপেরিমেন্ট পরিচয়ে।
কয়েক দশক আগেও মানসিক অসুস্থতার সংজ্ঞা ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট। কেউ সামান্য বিষণ্ণ হলেই 'ডিপ্রেসড' কিংবা কেউ একটু অদ্ভুত আচরণ করলেই 'স্কিৎজোফ্রেনিক' বলে আখ্যায়িত করতো। মানসিক হাসপাতালে একবার ঢুকলে অনেকেই আটকে থাকতেন বছরের পর বছর।
রোজেনহানের মনে একদিন হুট করে প্রশ্ন জাগে যে, যদি একজন একেবারে সুস্থ ব্যক্তি মিথ্যে বলে হাসপাতালে ভর্তি হতে চায়, তবে ডাক্তাররা কি বুঝতে পারবে যে সে পাগল নয়? এভাবেই শুরু হয় ইতিহাসের এক অভিনব মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা।
রোজেনহান আটজন স্বেচ্ছাসেবক বেছে নেন যাদের মধ্যে ছিলেন মনোবিজ্ঞানী, ছাত্র, গৃহিণী, এমনকি একজন চিত্রশিল্পীও। তাদের দেয়া নির্দেশাবলি ছিল সহজ। তারা হাসপাতালে ফোন করে বলবে, “আমার মাথার ভেতর কেমন অদ্ভুত শব্দ শুনছি, কেমন যেন ‘ফাঁকা’, ‘ফোঁপানো’, ‘ঠকঠক’।” তারপর একবার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলে তারা পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ করবে।
ফলাফল? সবাই ভর্তি হলো। সাতজনকে ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া’, একজনকে ‘ম্যানিক ডিপ্রেশন’ বলে ঘোষণা করা হলো।
হাসপাতালে রোগী হিসেবে ভর্তি হওয়ার পরই তারা পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ করলেও কেউ বুঝতে পারল না তারা সুস্থ। বরং তাদের প্রতিটি কাজ ব্যাখ্যা করা হলো অসুস্থতার লক্ষণ হিসেবে।
যেমন এক নার্স রোগীর রিপোর্টে লিখলেন: “রোগী নোট নেয়ার আচরণ করছে।” মানে শুধু নোট নিচ্ছে। অথচ এটিকেই অস্বাভাবিক ভাবে বর্ণনা করা হল।
রোজেনহান পরবর্তীতে বলেছিলেন যে, হাসপাতালের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত অমানবিক। রোগীরা ছিলেন পরিচয়হীন লেবেল যাদের নাম্বার দিয়ে ডাকা হত। তাদের যেন নাম ছিল না, মানুষ ছিল না তারা।
গড়ে প্রতিটি ছদ্মরোগীকে ১৯ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। একজন ছিলেন ৫২ দিন। অবশেষে সবাই ছাড়া পেলেন কিন্তু রিপোর্টে লেখা হলো “স্কিৎজোফ্রেনিয়া ইন রিমিশন।” অর্থাৎ তারা সুস্থ, কিন্তু এখনও 'পাগল' রয়ে গেছে!
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হলো রোজেনহানের গবেষণা যার শিরোনাম ছিল 'অন বিইং স্যান ইন ইনস্যান প্লেসেস' অর্থ অসুস্থ জায়গায় সুস্থা থাকা। সেখানে তিনি বলেন যে, “মনোরোগ হাসপাতালে আমরা সুস্থ ও অসুস্থ মানুষকে আলাদা করে চিনতে পারি না।”
এই একটি বাক্যেই পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। চিকিৎসকরা ক্ষুব্ধ, সাধারণ মানুষ ভীত, মনোরোগবিদ্যার উপর সবার বিশ্বাস রাতারাতি হারিয়ে গেল।
রোজেনহানের পরীক্ষায় ক্ষুব্ধ হয়ে এক নামী মানসিক হাসপাতাল চ্যালেঞ্জ করে যে, “এবার রোগী পাঠান, আমরা চিনে ফেলব।” কয়েক মাস পর তারা ঘোষণা করল যে ১৯৩ জন রোগীর মধ্যে ৪১ জন নকল! রোজেনহানের উত্তর? তিনি কাউকেই পাঠাননি। অর্থাৎ এবার আসল রোগীদেরই সন্দেহ করা হলো ছদ্মবেশী ভেবে! তার পরিণতি? মনোরোগবিদ্যার আত্মসমালোচনা।
এই পরীক্ষা মনোরোগবিদ্যার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে হাসপাতালগুলো নিজেদের নিয়ম ও ভর্তি প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হলো। যার ফলে ডিএসএম (ডায়াগনস্টিক এন্ড স্ট্যাট্যাস্টিকাল ম্যানুয়াল) নতুনভাবে সাজানো হয় যাতে মানসিক অসুস্থতার সংজ্ঞা আরও স্পষ্ট হয়। রোগীর অধিকার ও নৈতিক মানদণ্ড নিয়েও নতুন আলোচনা শুরু হয়।
অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে তারপর, কিন্তু আজও প্রশ্ন জাগে যে, সত্যিই কি আমরা “সুস্থ” আর “অসুস্থ”কে আলাদা করে বুঝতে পারি?
আজ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও, মানসিক রোগ নির্ণয়ের সীমারেখা আজও ঝাপসা। কখনও কখনও কিছু নির্দিষ্ট লেবেল বা স্টেরিওটাইপ সাহায্য করে চিকিৎসা পেতে, আবার কখনও তাই মানুষের ব্যক্তি পরিচয়কে গ্রাস করে ফেলে।
রোজেনহানের বার্তা ছিল স্পষ্ট সহানুভূতি আগে, সংজ্ঞা পরে। রোজেনহান আর কখনও তার পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেননি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া শিক্ষা আজও মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে।
প্রতিবার যখন কেউ বলে, “ও তো একটু পাগল”, তখন সেই পুরনো প্রশ্ন আবার ফিরে আসে, "কে পাগল, কে নয়?" হয়তো সত্যি বলতে সবচেয়ে বিপজ্জনক পাগলামি হলো এটিই ভাবা যে, আমরা সবসময় বুঝে ফেলতে সক্ষম যে কে আসলেই সুস্থ আর কে নয়।
samiulhaquesami366@gmail.com

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.