Bangla
2 years ago

মোহাম্মদপুরের মুন্না মামা: বৈচিত্র‍্যময় চাপ-কাবাব, হালিম ও স্যুপে জমজমাট

বয়সে তরুণ দোকানটি ইতোমধ্যেই পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ছবি: লেখক
বয়সে তরুণ দোকানটি ইতোমধ্যেই পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ছবি: লেখক

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

মোহাম্মদপুর এলাকা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ এর স্ট্রিটফুড, বিরিয়ানি, হালিম, চাপ ও কাবাব ধরনের আইটেমগুলোর জন্য। টাউন হলের বার্গার, হালিম, রাজকচুরী যেমন আছে, তেমনি আছে জেনেভা ক্যাম্পের প্রসিদ্ধ সব বিরিয়ানি-তেহারী। আরও আছে সলিমুল্লাহ রোডের বিখ্যাত কাবাব, দইবড়া-বাটিচাট, হালিম ও স্যুপ।

সুবিখ্যাত সেলিম কাবাব ঘরের পাশেই রয়েছে সুপরিচিত আরেকটি দোকান- 'মুন্না মামা হালিম স্যুপ এন্ড কাবাব ঘর'। 

এখানে আছে বিফ চাপ, বিফ বটি কাবাব, চিকেন চাপ, চিকেন বটি কাবাবের মতো প্রচলিত আইটেমগুলো। দেশি মুরগির চাপ, গরু-খাসির মগজ ফ্রাইও আছে। বিশেষত, এখানে আছে গুর্দা কাবাব ও খিরি কাবাব- যেটি সলিমুল্লাহ রোডের অন্যান্য দোকানগুলো করে না। 

হাঁস, টার্কি, কবুতর, কোয়েল এর  ফ্রাই কিংবা অল্প দামে চিকেন সাসলিক ও টিকা কাবাবও মিলবে এখানে। আর আছে হালিম ও স্যুপ। কাছেই মনা মামার সেই বিখ্যাত হালিম, আনোয়ার মামার হালিম ও স্যুপ, নওশাদ মামার স্যুপ। মুন্না মামার এখানে হালিম ও স্যুপ দুটোই মিলবে একসঙ্গে। 

দোকানটি খুব বড় নয়। একবারে বসতে পারেন ১২-১৪ জন মানুষ। দোকানে ঢুকতেই দেখা গেলো, বড় কড়াইয়ে চাপ ভাজছেন এক কারিগর। আর ব্যস্তভাবে লুচি পরিবেশন করছেন আরেকজন কর্মচারী। দোকানের ক্যাশে বসে থাকা মো. আবিদ গল্প করছিলেন তার এক বন্ধুর সাথে। দোকানের বয়স কত, এমন প্রশ্ন শুনে পাশে ফিরে তার সাথে কিছু বাতচিত করলেন। বন্ধুটিই বললেন, পনের বছরের মতো হবে।

তাদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আইটেম 'চিকেন চাপ'' ভাজছেন একজন কর্মী। ছবি: লেখক

 

জনাব আবিদের কাছ থেকে জানা গেলো, যার নামে এই দোকানের নাম- সেই মুন্না মামা এই দোকানের 'মাহাজন' (মহাজন)। তিনি মো. আবিদ এর বড় ভাই। লুচি পরিবেশন কর‍তে থাকা পাপ্পু বললেন, "আমরা এখানে যারা আছি, কেউ মালিক বা মহাজন না, আমরা কর্মচারী। মহাজন নিজে বসেন না খুব একটা।"

মো. আবিদের সূত্রে জানা গেলো, তারা আগে থাকতেন কলাবাগানে। বছর বারোর মতো হবে এদিকে এসেছেন। তিনি বললেন, "কলাবাগানে বড় ভাইয়ের (মুন্না) চাপের দোকান ছিলো। চাপ, কাবাব, হালিম। সেখান থেকে এখানে আমরা আসি বারো বছর আগে। ওখানে দোকান তিন বছরের মতো ছিলো।" 

তাদের হালিমের বিশেষত্ব হলো নরম, হাড়বিহীন মাংস ও একটি কোয়েল পাখির ডিম। এক বাটি হালিমের দাম ৮০ টাকা। এতে মাংস পাওয়া যায় ছোট করে কাটা ৪/৫ টুকরো। কোয়েল পাখির ডিমের বিষয়ে জানা গেলো, অন্য দোকানগুলোর থেকে ভিন্নতা আনতে ও স্বাদ আরো বাড়তে প্রতি বাটিতে কোয়েল পাখির একটি সিদ্ধ ডিম দেয়া হয়। 

হালিমের ডাল হিসেবে মুগ ও মসুর মিশ্রিত করে ব্যবহার করা হয়। মাংস সুসিদ্ধ। হাড়বিহীন ছোট মাংস ব্যবহার করেন তারা। মাংস সবসময়ই গরুর, জেনেভা ক্যাম্পের বাজার থেকে নিয়ে আসা হয়। 

স্যুপ নিয়ে বললেন, "এটা কর্নস্যুপ। চিকেন অল্প। সবজি থাকে- পেঁপে, গাজর। তেল, মশলা নাই। স্বাস্থ্য নিয়ে যারা বেশি সচেতন তারা খান। হালিম-স্যুপ দুটাই মোটের ওপর ভালো বিক্রি হয়।" 

তবে এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চিকেন চাপ। তিনি জানান, "চাপের বিক্রি মনে করেন, ডেইলি চিকেন ১৫০ পিস ও গরু ৮০ পিসের মতো বিক্রি হয়। চিকেন চাপ সবচেয়ে বেশি চলে। এরপর চিকেন বটি, গরুর চাপ বা বটি। তবে এগুলাই মানুষ বেশি নেয়। যাদের ব্রয়লার পছন্দ না, তাদের জন্য দেশি মুরগির চাপ আছে, তবে সেটা মোটামুটি চলে।" 

এর ভেতর দেশি মুরগির চাপ ১৩০ টাকা, বাকি সবগুলো আইটেম (চাপ/বটি) ১১০ টাকা করে। প্র‍তিদিন সকালে মেরিনেট করা হয়। দুপুর থেকে বিক্রি-বাট্টা শুরু হয়। তবে আগে থেকে ভেজে রাখা হয় না। অর্ডার এলে তখনই ভাজা হয়।

মূল্যতালিকায় সবচেয়ে দামি খাবার কবুতর ফ্রাই। ছবি:লেখক

খাসির চাপ/বটি/মগজ ফ্রাই একসময় রাখতেন। তবে এসবের তেমন চাহিদা নেই বলে আর রাখেন না - এমনটিই জানালেন মো. আবিদ। 

তাদের দোকানের আলাদাভাবে আকর্ষণ হলো গুর্দা কাবাব, খিরি কাবাব৷ এছাড়া, হাঁস ফ্রাই, টার্কি ফ্রাই, কবুতর ফ্রাই, কোয়েল পাখি ফ্রাই পাওয়া যায়। 

কবুতর ফ্রাই সবচেয়ে দামি আইটেম - ২৫০ টাকা। তবে খুব বেশি চাহিদা না থাকায় সব দিন পাওয়া যায় না। কবুতর ও কোয়েল পাখি ফ্রাই করার ক্ষেত্রে কাটা হয় না। 

মো. আবিদ জানান, "এগুলা আস্ত ফ্রাই করা হয়। তবে চলে তুলনামূলক কম। হাঁস ফ্রাই, টার্কি ফ্রাই এখন পাবেন না। এগুলা শীতের সময়ে করা হয়।" 

মাঘ মাস চলছে এখনো, সে কথা বললে উত্তরে  বললেন, "মাঘ মাস চললেও শীতের তো দেখা নাই। আর হাঁস এখন আর ওরকম কোয়ালিটির হবে না। আরো শীতে হাঁসের তেল ভালো হয়। এখন গরম পড়তেছে। এখন আর ওরকম স্বাদ হবে না।" 

খিরি ও গুর্দা কাবাবের প্রথমটি গাভীর ওলান থেকে ও দ্বিতীয়টি গরুর কিডনি-ফুসফুস মিলিয়ে তৈরি করা হয়। তিনি জানান, "এগুলা চলে কম। মোটামুটি যায়। তবে রেগুলারই বানানো হয়। অল্প করে করা হয়। সেটা শেষ হয়। সব দোকানে পাওয়া যায়না, বা করেনা। তবে কারো কারো খিরি বা গুর্দা পছন্দ৷ তাদের কথা চিন্তা করে আইটেমগুলা রাখা হইছে।" 

এসব আইটেমের বাইরে চিকেন শাসলিক, টিকা কাবাব অনেকে বিকেলে/ সন্ধ্যায় নাস্তা হিসেবে খান। এ দুটো তুলনামূলক কমদামে পাওয়া যায়। 

লুচি সারাদিনে আনুমানিক কত বিক্রি হয়, এর উত্তরে মো.আবিদ বললেন, "এটার কোনো হিসাব নাই। প্রতি পিস পাঁচ টাকা করে। যে যতটা খায়। দিনে ৩০০ মানুষ খাইলে ২০০০-২৫০০ পিস, কোনোদিন ৩০০০ পিসও যাইতে (বিক্রি হতে) পারে।" 

তাদের হালিমে থাকে একটি কোয়েল পাখির ডিম ও ছোট করে কাটা সুসিদ্ধ গরুর মাংস। ছবি: লেখক

প্রতিদিন দুপুর দুটোয় দোকান খোলেন তারা। থাকেন রাত বারোটা বা তার কিছুটা পরও। সাধারণত শুক্রবারে বা বৃহস্পতিবার রাতে ভিড় বেশি হয়। এছাড়া প্রতিদিনই সন্ধ্যা সাতটা-রাত দশটার ভেতর ভিড় বেশি থাকে। দোকান ছোট হওয়ায় খুব বেশি মানুষ একবারে বসতে পারেন না। তবে সেটি সাধারণত সমস্যা তৈরি করে না বলেই জানা গেলো। 

ভোজনরসিকরা দুরদুরান্ত থেকেও আসেন। যেমন- দেখা গেলো কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মী আলাদা কয়েকটি জায়গা থেকে রাত এগারোটার সময়ও এসে বসলেন দোকানে। একজন বললেন, "ছয়টা স্যুপ, ছয়টা চাপ দাও আর লুচি অগণিত। চাপ চিকেনই দাও। কড়া করে ভেজে দিও।"

তারা খেতে থাকলেন। মো. আবিদ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পাপ্পু ও অন্যান্য কর্মীদের সাথে। লুচি একের পর এক গরম ভাজা হচ্ছে, একটু পরই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর ডুবো তেলে প্রস্তুত হচ্ছে চিকেন চাপ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরের সময়টা থেকে দোকান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এভাবেই যেতে থাকে।

মাহমুদ নেওয়াজ জয়  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা  বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। 

mahmudnewaz939@gmail.com 

শেয়ার করুন