Bangla
a year ago

মুখরোচক স্বাদে রাজশাহীর হরেক রকম মিষ্টি 

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

পদ্মার তীর ঘেঁষা রাজশাহী শহরে কেউ বেড়াতে এলে প্রথমেই হয়ত ভাবেন আমের সিজনে এলে সারি সারি দোকানে আম পাওয়া যেত, কিংবা অনেকেই হয়ত ভাবেন কালাইয়ের রুটি খাওয়ার কথা, যা এই সামগ্রিক রাজশাহী-চাঁপাই নবাবগঞ্জ অঞ্চলের নিজস্ব স্মারক বলা যায়। 

কিন্তু আলোচনায় তুলনামূলক পিছিয়ে আছে রাজশাহী অঞ্চলের অনন্য মিষ্টান্ন। সর্বপরিচিত রসগোল্লা কিংবা চমচম তো রয়েছেই, এছাড়াও রয়েছে স্বাদ ও আকারে ভিন্নতা নিয়ে হরেক রকম চেহারার হরেক নামের মিষ্টি। এসব মিষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য - কালোজাম, রসকদম, কমলাভোগ, ক্ষীরভোগ, রাজভোগ, লবংগ লতিকা, ছানার জিলাপি, ইত্যাদি। এই মিষ্টি তৈরির মতো এদের নামকরণও শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। 

মিষ্টিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অগণিত নামী-দামী মিষ্টি বিক্রয়কেন্দ্র। শহরে প্রবেশ করলেই রাস্তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে মিষ্টির দোকান। এসব মিষ্টির দোকানের মধ্যে অধিক জনপ্রিয় রাজশাহী মিষ্টান্ন ভান্ডার, নবরূপ, শামীম সুইটস,  মিষ্টিবাড়ী ও মিষ্টিমহল। 

রাজশাহীর কিছু ঐতিহ্যবাহী দোকান যুগযুগ ধরে মিষ্টি তৈরী করেই মানুষের জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে। এক একটা মিষ্টি তৈরীর এইসব প্রতিষ্ঠান দেশের ইতিহাস, পরিবর্তন ও সংস্কৃতির সাক্ষী। খাঁটি ছানা, মাওয়া, পোস্তদানা, চিনি ও নলেন গুড় ব্যবহার করে কারিগরদের দক্ষ হাতে তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী এসব মিষ্টি।

এমনই এক মিষ্টির নাম রসকদম। নামের মতই কদম ফুলের মত তার গড়ন। গোলাকার গুড়ের মিষ্টির উপরের স্তরটিতে সাদা হোমিওপ্যাথির ওষুধের মতো গুড়ি গুড়ি সাদা মিষ্টি দানা। গুড়ের মিষ্টির মধ্যে আবার রয়েছে রসে ভরা ছোট্ট আরেকটি মিষ্টি। অর্থাৎ, তিন ধরনের মিষ্টির সমন্বয়ে এই রসকদম। এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় রসকদম পাওয়া গেলেও রাজশাহী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি বিক্রেতার বক্তব্য, “রাজশাহী থেকেই রসকদম মিষ্টির যাত্রা শুরু।”  

রাজশাহীর মিষ্টিসমগ্রের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় নাম কমলাভোগ। কমলা রঙের কমলালেবুর স্বাদের রসে টসটসে এই মিষ্টির উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গ হলেও বাংলাদেশে এর পথচলা শুরু উত্তরবঙ্গ থেকেই। প্রথমদিকে ফলের রস ছানার সাথে মিশিয়ে এই মিষ্টি তৈরী করা হলেও, বর্তমানে ফুড কালার ও ফ্লেভার যুক্ত করার প্রচলন বেশী। 

জনপ্রিয় মিষ্টির তালিকায় রয়েছে ক্ষীরভোগও। কিছুটা বেলন আকৃতির বাদামী প্রলেপে জড়ানো সাদা ছানা এই মিষ্টিটি বৃহত্তর রাজশাহীর মানুষের প্রিয় মিষ্টির তালিকায় অন্যতম। নলেনগুড়ের চারকোণা আকারের রাঘবশাহী সন্দেশও এ অঞ্চলের অন্যতম পছন্দের মিষ্টি।  

রাজশাহীর আরেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি হোবাঘোষের মিষ্টি। পুলিশ সুপারের কার্যালয় পেরিয়ে একটু সামনে টং ধরনের এই দোকানটির বয়স নিরানব্বই বছর। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং শতকের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে হোবা ঘোষের দোকান। চার প্রজন্মের ঐতিহ্য বহনকারী এই দোকানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সাদা রসগোল্লা। 

ছানা, ময়দা, মাওয়া, গুড়া চিনি, ঘি, গোলাপ জল দিয়ে তৈরি ছানার কালোজাম দেশের বাকি অঞ্চলে সহজলভ্য হলেও রাজশাহীর কালোজাম যেন একটু অনন্য ধাঁচের। নবরূপ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি বিক্রেতা মিষ্টির গল্প করতে করতে বলেন, “রাজশাহীর কালোজামের মত এই রঙ এবং স্বাদের কালোজাম আপনি আর কোথাও পাবেন না। বাইরের শহর থেকে যারা বেড়াতে এসে এ মিষ্টি খেয়েছে, তারাও একথা স্বীকার করবেন।” 

সপ্তাহের সাতদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতে থাকে মিষ্টির সরবরাহ। প্রতি পিস মিষ্টির দাম সর্বনিম্ন পনের টাকা হতে সর্বোচ্চ ত্রিশ টাকা, কেজি দরে ২০০-৩০০ টাকা। 

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে রাজশাহী শহর এবং বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের নানান ধরনের মিষ্টি এখন সরবরাহ হচ্ছে দেশের অন্যান্য জেলায়ও। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উপলক্ষ ও উৎসবে মিষ্টিমুখ করিয়ে আপ্যায়নের সংস্কৃতি এ অঞ্চলে এখনো শক্তিশালী।  

তবে মিষ্টির কারিগর পরিবারগুলোতে আগে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই পেশা বহমান হলেও, এখন ধীরে ধীরে পেশার পরিবর্তন ঘটছে। দায়িত্বের হাতবদলের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মিষ্টি কেনাবেচা কিংবা এর বানানোর প্রক্রিয়ার মতো স্বাদেও আসছে পরিবর্তন। 

অন্যদিকে, ক্রমশ ফাস্টফুড ও অন্যান্য প্যাকেটজাত খাবারের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলায় একদিকে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কাও তৈরী হচ্ছে মিষ্টান্নের ব্যবসায়। তবে এ অঞ্চলে পর্যটনের উন্নয়ন হলে এবং নিজেদের সংস্কৃতির প্রচারে প্রসার ঘটাতে পারলে এই ঝুঁকি মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয় অনেকেই। 

[email protected]

শেয়ার করুন