প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি কোক স্টুডিও বাংলা সিজন ২ এর প্রথম গান ‘মুড়ির টিন’ রিলিজ হয়। চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া এ গান পায় তুমুল জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের প্রাচীন গণপরিবহণ মুড়ির টিন বাস সার্ভিসকে কেন্দ্র করেই মূলত এই গানের কথা লেখা হয়েছে। চলুন আজ জেনে নেয়া যাক এই মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস।
বর্তমানে যদিও পুরাতন ও লক্করঝক্কর মার্কা বাসকে মুড়ির টিন বলে ডাকা হয়। কিন্তু, আমাদের দেশে সড়কপথে প্রথমদিকের গণপরিবহণ ছিল এই মুড়ির টিন বাস। বাসের নাম মুড়ির টিন হওয়ার পিছনে রয়েছে এক অদ্ভুত কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমাদের অঞ্চলের মিত্রবাহিনীদের ব্যবহার করা যানবাহন এদেশের বিত্তশালীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এসব যানবাহনের মধ্যে ছিল ট্রাক, জিপ গাড়ি, ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও ভাঙ্গাচোরা কিছু গাড়িও বিক্রি করা হয়।
কোক স্টুডিওর মুড়ির টিন গানের দৃশ্য, ছবি: ফেসবুক
এগুলো গাড়ির ছিল কাঠের বডি। বিত্তশালীরা এসব কাঠের বডির গাড়িকে নাকবোঁচা বাসের আদলে মেরামত করতো। ইঞ্জিন আমদানি করা হতো যুক্তরাজ্য থেকে। অনেক সময় কাঠের বডি স্থানীয় মিস্ত্রীরাও তৈরি করতো। কাঠের বডির ওপরে মুড়ে দেয়া হতো টিন। নৌকার ছাউনির মতো করে বাসের ওপরে টিনের ছাউনি দেয়া হতো, যেন বৃষ্টি এলে যাত্রীরা ভিজে না যায়। বাসের ভেতরে চারধারে বেঞ্চের মতো করে সিট বসানো হতো। ২০-২২ জন বসার সুযোগ পেত। ৫০ জনের বেশি যাত্রী দাঁড়িয়েই থাকত। স্টিলের জানালার পুরোটাই খোলা যেত বলে বাতাস চলাচলের সুযোগ ছিল বেশি। মূলত এ থেকেই বাসগুলোর নাম হয়ে যায় মুড়ির টিন বাস।
আবার অনেকে বলে বাসে মুড়ির মতো ঠেসে যাত্রী ঢোকানো হতো বলে এই বাসের নাম হয়ে যায় মুড়ির টিন। এই মুড়ির টিন বাসগুলোকে স্টার্ট বাসও বলা হতো। বাংলা ‘দ’ আকৃতির একটি লোহার দন্ডের এক মাথা ইঞ্জিনে প্রবেশ করিয়ে জোরে ঘুড়িয়ে স্টার্ট দেয়া হতো বলেই এই নাম। পরে অবশ্য চাবি দিয়ে বাস চালুর ব্যবস্থা করা হয়। বাসে ছিল না কোনো ইলেকট্রনিক বা হাইড্রোলিক হর্ন। ড্রাইভারের ডান পাশে দরজার সাথে ভেপু বা হর্ন ছিল। ড্রাইভার হাত দিয়ে চেপে এই হর্ন বাজাতো। আবার অনেক বাসে পিতলের হর্ণ ব্যবহার করা হতো।
বাসগুলো মূলত ঢাকা শহরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হতো। দূরপাল্লার পরিবহণ হিসেবে মুড়ির টিন বাস ব্যবহার হতো না। চকবাজার, গুলিস্তান, সদরঘাট, নবাবপুর, ইসলামপুর এসব জায়গায় চলতো মুড়ির টিন বাস। এরপরে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, মিরপুর, আরিচা, ডেমরা ও রামপুরা, কালিয়াকৈর, নয়ারহাট রুটেও চলাচল শুরু করে। মুড়ির টিন বাসকে সর্বশেষ বাহাদুর শাহ পার্ক বা সদরঘাট রামপুরা-কুড়িল রুটে ও গাজীপুর থেকে সায়দাবাদ রুটে নিয়মিতভাবে চলাচল করতে দেখা গেছে।
বর্তমানে যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, এর পেছনে ছিল বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ছেড়ে চিত্রামহল, নাজিরা বাজার, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, পল্টন হয়ে রামপুরা যেতো বাসগুলো। প্রতি ট্রিপ ছিল মোটামুটি ২৫ মিনিটের। প্রতি মিনিট দেরির জন্য জরিমানা দিতে হতো ৫ টাকা। বাসের গতি ছিল সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার। তাই বলা যায় মোটামোটি আস্তেই চলতো বাস। মুড়ির টিন বাস শুধু ঢাকাতেই চলতো ব্যপারটা এমন না। যশোর, বেনাপোল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ বড় শহরগুলোতে চলতো মুড়ির টিন বাস। বাসের ভাড়া ছিলো আনাখানেক।
সত্তর ও আশির দশকে বেশি চলতো মুড়ির টিন বাস। ২৫ বছরের পুরনো গাড়ির ফিটনেস বাতিল করা হলে আশির দশকের পর ঢাকা থেকে মুড়ির টিন বাস প্রায় উঠে যায়। তবে মুড়ির টিনের পরেও কাঠের তৈরি বডির বাস ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত থাকে।
বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে মুড়ির টিন বাসের রূপায়ন হয়েছে বিভিন্নভাবে। হুমায়ূন আহমেদের ‘অনীল বাগচির একদিন’ উপন্যাস অবলম্বনে হওয়া সিনেমায় এসেছে মুড়ির টিন বাস। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন তার স্মৃতিকথায় মুড়ির টিন বাস নিয়ে লিখেছেন। তানভীর মোকাম্মেলের সিনেমা ‘চিত্রানদীর পাড়ে’ সিনেমায় যশোর-বেনাপোলের রাস্তায় চলাচল করতে দেখা যায় মুড়ির টিন বাস।
কালের বিবর্তনে এই ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাস হারিয়ে গিয়েছে। এখন ঢাকার লোকাল পরিবহণেও এসি বাসের দেখা পাই আমরা। প্রযুক্তির অতিশায্যে পুরাতনকে হটিয়ে নতুনরা স্থান করে নিবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই কোক স্টুডিওর নতুন গান ‘মুড়ির টিন’ শুনে আমাদের আগের প্রজন্মের যারা মুড়ির টিন বাসে চড়েছেন, তারা স্মৃতিকাতর হবেন নিশ্চয়ই।
ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।