ময়মনসিংহে এলজিইডি'র ৭২ শতাংশ সড়কই কাঁচা, দুর্ভোগে প্রান্তিক মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
১১টি সংসদীয় আসন, সিটি করপোরেশন, ১৩টি উপজেলা, ১০টি পৌরসভা ও ১৪৫টি ইউনিয়নের প্রায় পৌনে এক কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ময়মনসিংহ জেলায় স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) গ্রামীণ কাঁচা সড়কগুলোর তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। এখনও জেলার গ্রামীণ সড়কগুলোর ৭২ শতাংশই কাঁচা রাস্তা যা অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় ওই সড়কগুলোতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও আবার রাস্তা ভেঙে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
কাঁচা সড়কগুলোর বেহাল দশার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। ভাঙ্গাচোরা ওইসব সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন কৃষিজীবী-শ্রমজীবী ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লাখো মানুষ। পাকা রাস্তা কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য দ্রুত শহরে নিতে পারছে না এবংপণ্যের সঠিক মূল্যও পাচ্ছে না।
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ওইসব কাঁচা সড়কগুলো যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে চলাচলকারীদের প্রতিদিন পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে কার্পেটিং ও খোয়া উঠে গিয়ে গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এসব সড়কে যানবাহন উল্টে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে, পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবেই সংস্কার কাজ সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সড়ক নির্মাণ ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা এখন সময়ের দাবী।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) অধীনে ময়মনসিংহ মহানগর ও জেলার ১০টি পৌর এলাকাসহ ১৩টি উপজেলা এলাকায় ১৩ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার মোট গ্রামীণ সড়কের মধ্যে ৭২ শতাংশই কাঁচা। এসব কাঁচা গ্রামীণ সড়কের ৯ হাজার ৫৬৩ কিলোমিটার সড়কই বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো কোনো সড়কে স্বাভাবিক চলাচলও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এসব সড়কের কোনোটি সংস্কারের এক বছরের মধ্যে ফের বেহাল হয়ে পড়েছে, আবার কোনটি এক যুগেরও অধিক সময় ধরে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে না। সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জেলায় মাত্র ২৮ শতাংশ গ্রামীণ সড়র পাকা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) হালনাগাদকৃত তথ্য মতে ময়মনসিংহ জেলায় ১৩টি উপজেলা এলাকায় সর্বমোট ১৩ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার মোট গ্রামীণ সড়কের মধ্যে তিন প্রকারের গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। তার মধ্যে ৩ হাজার ৭৬৭ কি.মি. রাস্তা পাকা যা শতকরা ২৮ শতাংশ অবশিষ্ট ৯ হাজার ৫৬৩ কি.মি. রাস্তাই কাঁচা। এলজিইডি’র অধীনে রাস্তাগুলো তিনস্তরের যা উপজেলা সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক ও গ্রামীণ সড়ক।
জেলার ১৩ উপজেলায় ১ হাজার ১৪৫ কিলোমিটার উপজেলা সড়কের মধ্যে ১ হাজার ৪৮ কি.মি.পাকা এবং ৯৭ কি.মি. কাঁচা। জেলায় মোট ইউনিয়ন সড়কের পরিমাণ ১ হাজার ৭১৬ কি.মি. যার মধ্যে পাকা ১ হাজার ৭২ কি.মি. এবং কাঁচা রাস্তা ৬৪৩ কি.মি.। পাকা রাস্তার হার ৬৩ শতাংশ। এছাড়াও জেলায় মোট গ্রামীণ সড়কের পরিমাণ ১০ হাজার ৪৭০ কি.মি. এর মধ্যে পাকা রাস্তার পরিমাণ মাত্র ১ হাজার ৬৪৭ কি.মি.। অবশিষ্ট ৮ হাজার ৮২৩ কি.মি. রাস্তাই কাঁচা, গ্রামীণ সড়কের মাত্র ১৬ শতাংশ পাকা। মোট গ্রামীণ সড়কের ৮৪ শতাংশই কাঁচা।
অপরদিকে বিভাগীয় সদর ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ১ হাজার ৪২৫ কি.মি. রাস্তার মাঝে অধিকাংশ এখনো কাঁচা। কাঁচা রাস্তার পরিমাণ ৭৪২.৩৭ কি.মি.।
ময়মনসিংহ জেলায় ১০ হাজার ৪৭০ কি.মি. সর্বমোট গ্রামীণ রাস্তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ অর্থাৎ কাঁচা বৃহৎ ৮ হাজার ৮২৩ কি.মি. রাস্তাই বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে।
জেলার ১৩টি উপজেলা হচ্ছে- হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, ফুলপুর, তারাকান্দা, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, গফরগাঁও, ভালুকা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ সদর, ফুলবাড়ীয়া ও মুক্তাগাছা। এদিকে গ্রামীণ পর্যায়ে আরো অনেক সড়ক রয়েছে যেগুলোর এখনও এলজিইডি কর্তৃক আইডি পড়েনি।
ময়মনসিংহ জেলার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ সড়কই কাঁচা থাকায় গ্রামীণ কৃষকের উৎপন্ন শস্য ও কৃষিপণ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহরাঞ্চলের বাজারে পৌঁছাতে পারছে না। ফলে কৃষকরা তাদের পণ্যে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সার্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে। গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হওয়ার সঙ্গে সেখানকার জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
জেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক এখনও কাঁচা অবস্থায় রয়েছে যেখানে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে যায় সড়কগুলো, আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলোর কারণে চলাচলে সমস্যা হয়। বিশেষত শিক্ষার্থীরা, রোগী পরিবহনকারী স্বজনরা এবং সাধারণ জনগণ নিয়মিত এই কষ্ট সহ্য করে চলতে হয়। স্থানীয়রা এই সড়কগুলোর উন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও, গ্রামীণ সড়কগুলোর বর্তমান অবস্থা তাদের জন্য দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চরম ভোগান্তি তৈরি করছে।
এ বিষয়ে এলজিইডির ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী সালমান রহমান রাসেল বলেন, "প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র এক-সপ্তমাংশ অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়। ফলে সংস্কারের চাহিদা থাকলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। তবে কাঁচা সড়কগুলো ধাপে ধাপে পাকাকরণের পরিকল্পনা রয়েছে।"
স্বাধীনতার পর জেলার গ্রামীণ কাঁচা সড়কগুলোর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, "সামান্য বৃষ্টি হলেই ওই রাস্তা পাড়ি দিতে আমাদের দশ কিলোমিটার ঘুরতে হয়। আমার দাদা-বাবাও এমন অবস্থায় ছিলেন, আর আমরা জানি না, এই রাস্তাটি উন্নত হবে কিনা।"
অপরদিকে, ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কাজির কান্দা গ্রামের একজন ইজিবাইক চালক শফিক রহমান বলেন, "বর্ষাকালে কাঁচা সড়কগুলোর কারণে আমাদের খুবই কষ্ট হয়। হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতে পারি না, কারণ সড়কগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়। অন্তঃসত্ত্বা রোগীদের জন্য এটি মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে।"
এলাকার বাসিন্দারা তাদের সড়কগুলোর উন্নয়ন ও পাকাকরণের জন্য বারবার দাবি জানিয়েছেন। ধোবাউড়া উপজেলার মোকাম্মেল ইসলাম বলেন, "এমন অবহেলিত কাঁচা সড়কগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া, শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে পৌঁছানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি, সড়কটি সংস্কার করা হোক।"
এছাড়া, হালুয়াঘাট উপজেলার মকবুল হোসেন বলেন, "বর্ষা মৌসুমে কাঁচা সড়কগুলোতে কোনো অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, ভ্যান বা রিকশা ঢুকতে চায় না। এমনকি মোটরসাইকেল বা সাইকেলও চলাচল করতে পারে না। বৃষ্টির দিনে কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো পরিবহন পাওয়া যায় না।"
এলজিইডির সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুস সবুর বলেন, "মেরামতে যত দেরি হবে, মেরামত খরচও তত বাড়বে।" এলজিইডির কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অতি বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক সুর্যোগসহ গত জুলাইয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন, আগস্টে সরকারের পতন এবং নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনিক ও সব ধরনের উন্নয়ন কাজ থেমে গেছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরে ভাঙা সড়কের পরিমাণ ও দুর্ভোগও বেড়েছে।
"ফলে চাহিদার তুলনায় এত কম বরাদ্দ দিয়ে বিশাল একটি অংশ মেরামত করা সম্ভব হবে না," বলেন তিনি।
এই প্রকৌশলী আরও জানান, চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ দিয়ে আনুমানিক ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করা সম্ভব হবে। কত কিলোমিটার সড়ক মেরামত করা যাবে, তা নির্ভর করবে অর্থছাড় ও দরপত্রের ওপর। কারণ প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ অর্থবছরের শুরুতে দেওয়া হয়, তার পুরোটা ছাড় করে না সরকার। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকেও পুরাতন কিছু সড়ক মেরামত করা হয়। মেরামতে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেট থেকে ব্যয় হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এলজিইডির সড়কগুলো ৩৫ বছরের মধ্যে পিরিয়ডিক মেরামত করতে হয়। তবে তহবিল বরাদ্দ কম হওয়ায় মেরামতের কাজ চালাতে হয় সীমিত পরিসরে। এছাড়া বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের করাণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে বলে জানান কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিপার্টমেন্টের (আইএমইডি) এক কর্মকর্তা বলেন, "নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, অদক্ষ ঠিকাদার এবং দুর্নীতির কারণে সড়ক প্রকল্পগুলো টেকসই হয় না।"