Bangla
a year ago

ময়মনসিংহের শশী লজ: স্নানরত গ্রিক দেবী আর হুমায়ুনের 'অয়োময়ে'র মাঝে

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

ময়মনসিংহের জমিদার বাড়ি, বেশি পরিচিত শশী লজ নামে। ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই জমিদার বাড়ি। গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ মূল্য ত্রিশ টাকা। টিকেট কেটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি মূর্তি। মূর্তিটি  গ্রিক দেবী ভেনাসের।

 স্নানরত সেই মূর্তিটির চারপাশে বাগান। মাঝখানে ফোয়ারা।আরও কিছুদূর সামনে গেলে জমিদার বাড়ির দৃষ্টি নন্দন কারুকাজ চোখে পড়বে। ময়মনসিংহের এই জমিদার বাড়ি শশী লজে ঐতিহাসিক গ্রিক দেবী ভেনাসের মূর্তি ছাড়াও ছিল দূশ্প্রাপ্য নাগালিঙ্গম (যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো), পদ্মবাগান, জলঘরের মতো এমন অসংখ্য ঐতিহাসিক বিষয়। 

তাছাড়া, হুমায়ূন আহমেদ রচিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক ‘অয়োময়’এর শ্যুটিং এখানেই হয়েছিল, যা বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। অয়োময় নাটকের সেই ধারাবাহিক পর্বগুলো মনে পড়লে শশীলজের দৃশ্যই ভেসে উঠবে।

নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় নাটক ‘অয়োময়’ এর বিখ্যাত চরিত্র ‘ছোট মির্জা’। এ চরিত্রের জনপ্রিয় সংলাপ ছিল ‘আমি বেশি কথা বলতে পছন্দ করি না’। ভাটি অঞ্চলের প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের সেই ‘ছোট মির্জা’ চরিত্র  তিন দশক আগেরও বেশি সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে। আমাদের মনে করিয়ে দেয় ছোট মির্জাকে, যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। 

অয়োময়ের গল্প ভাটি অঞ্চলের এক পড়তি জমিদারের পতনকে ঘিরে। তবে, জমিদারের পরিবার, গ্রামবাসীর জীবনের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা আর উঠতি বিত্তবান এক নব্য ধনীর সেই জমিদারী কিনে নেয়া গল্পের অনেক বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে। এখন কেউ ময়মনসিংহের এই জমিদার বাড়িতে গেলে যেন চোখে ভেসে আসবে নাটকের দৃশ্য।

জমিদারদের দত্তকের ঘটনা ও আজকের শশীলজ

মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। তার তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। তাই দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তিনি। পরে গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিয়ে মৃত্যুর আগে দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করেন। এর পেছনের কারণ ছিলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোর মতো  সম্পত্তি সংরক্ষণ করবে পুত্রসন্তান । 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ভাগ্য জমিদারদের সহায় হয়নি। তাই পুত্র সন্তানের আশায় একেরপর এক চলতে থাকে দত্তক নেওয়ার কাজ। এভাবে পালাক্রমে পুত্র সন্তানের জন্য দত্তকের ঘটনায় লক্ষ্মী দেবী পূর্ণচন্দ্র মজুমদারকে দত্তক নিয়ে নতুন নাম রাখলেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার করলে অনেক  কাজও করলেন । তিনি ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা।

ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে ৯ একর ভূমির ওপর একটি  দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তার জন্যও সহায় হয়নি। কারণ, তিনিও ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি দত্তক  নিলেন শশীকান্তকে। পরে শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে ভবনটির  নাম হয় 'শশী লজ'।

সূর্যকান্তের নির্মিত প্রাসাদটি ভূমিকম্পে  বিধ্বস্ত হওয়ায় তার দত্তকপুত্র শশীকান্ত প্রাসাদটি পুণর্নিমাণ করেছিলেন।

দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ কাঠামো 

মূল ফটকে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই ছাদ থেকে ঝুলন্ত বেশ কয়েকটি ঝাড়বাতি। ছিল নাচঘর, স্নানঘর। স্নানঘরে  একটি সুড়ঙ্গও আছে। অনেকের মতে, এই সুড়ঙ্গপথে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। 

মূল ভবনের পেছনভাগেও রয়েছে একটি স্নানঘর। এই দোতলা স্নানঘরে বসে রানী পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। 

বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ। এর পাশেই রয়েছে পদ্মবাগান। এই ভবনের পূর্বপ্রান্তের ঘরটি বর্তমানে ব্যবহূত হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। \

শশী লজের অন্দরে বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো  কাচের ঝাড়বাতি। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সেই উঠান পেরোলেই একটি  জলাশয়। 

২০১৯ সালে এটি  জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। রাজমহলের মোট ১৮টি কক্ষের মধ্যে ৩টি কক্ষে রাজবাড়ীর পুরাকীর্তি, রাজার ব্যবহার্য জিনিস, আসবাবপত্র সংরক্ষণ করে রাখা আছে। 

দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এই জমিদার বাড়িটি অসম্ভব সুন্দর। বাড়ির প্রতিটি দেয়াল একেকটি ইতিহাস বহন করে। এই প্রাসাদ, জলঘর, নাচঘর, জলাশয়গুলো এখনো জানান দিয়ে চলেছে নিজেদের অস্তিত, কেবল নেই তাদের নতুনের জৌলুশ আর তাদের ঘিরে থাকা মানুষগুলো। 

shakibtahmid05@gmail

শেয়ার করুন