নতুন বাজেটে বাণিজ্য জরিমানা হ্রাস ও নিত্যপণ্যে কর কমানোর প্রস্তাব
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
নতুন বাজেটে একাধিক বাণিজ্য সহায়ক ব্যবস্থা যেমন পুঁজিবাজারে কর্পোরেট ট্যাক্স সংক্রান্ত নীতিমালা, বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট অপরাধে শাস্তি হ্রাস এবং ওষুধ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর হার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্স ২.৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফলে তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ব্যবধান বেড়ে দাঁড়াবে ৭.৫ শতাংশে।
এই অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে, যেখানে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার অপরিবর্তিত থাকবে ২৭.৫ শতাংশে।
বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ২২.৫ শতাংশ কর দেয়। সে হিসেবে বর্তমানে ব্যবধান ৫ শতাংশ।
এই বাজেটীয় উদ্যোগটি ২ জুন ঘোষিত হবে এবং এটি আরও বেশি কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, কিছু বাণিজ্য সহায়ক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আমদানি ঘোষণায় ভুল বা আমদানির সাধারণ ম্যানিফেস্টো (আইজিএম) এবং আমদানি নীতিতে সাধারণ ভুলের জন্য জরিমানা হ্রাস এবং আদালতে বিচারাধীন ট্যাক্স দাবির ক্ষেত্রে সুদের মেয়াদ কমানো।
বর্তমানে আমদানি পণ্যে ভুল ঘোষণায় সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হয়। নতুন অর্থবছরে এটি কমিয়ে ২০০ শতাংশ করা হতে পারে।
আইজিএম-এ সাধারণ ভুলের জন্য বর্তমানে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ জরিমানা ধার্য রয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, এই ন্যূনতম জরিমানা তুলে দেওয়া হবে এবং ভুলের গুরুত্ব অনুযায়ী কর পরিশোধ করতে দেওয়া হবে।
পণ্যে ভুল ঘোষণায় ন্যূনতম জরিমানার পরিমাণ যেটি বর্তমানে ৫০ হাজার টাকা, সেটিও বাতিল করা হবে।
আইপিও (আমদানি নীতি আদেশ)-তে অসামঞ্জস্যতা থাকলে বর্তমানে ন্যূনতম ১০০ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়। সেটির ন্যূনতম সীমাও তুলে দেওয়া হবে।
আদালতে বিচারাধীন ট্যাক্স দাবিতে বর্তমানে ১০ বছর পর্যন্ত সুদ গণনা করা হয়। এই নিয়ম পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করা হবে। অর্থাৎ, আদালতে মামলা চলাকালীন ও নিষ্পত্তির পরে ব্যবসায়ীরা ১০ বছরের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ২ বছরের সুদ দিতে হবে।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট কর সুবিধা বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ব্যবধান কমপক্ষে ১০ শতাংশ হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, "আমরা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে কর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছি। তবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে করপোরেট কমপ্লায়েন্স বজায় রাখার কারণে অনেকের কর বাড়ে। যতক্ষণ না আরও কোম্পানি আসে, বাজার অস্থিরই থাকবে এবং কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে সামগ্রিক সূচকও প্রভাবিত হবে।"
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল আলম সরকারের কর ব্যবধান বাড়ানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটি আরও বড় ও খ্যাতনামা কোম্পানিকে বাজারে আনবে।
তিনি আরও বলেন, "সম্প্রতি জেনেছি, প্রস্তাবিত ব্যবধান হবে ৭.৫ শতাংশ। এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ। তবে আমরা সরকারের কাছে আবারও অনুরোধ জানাচ্ছি, এটি ১০ শতাংশ করা হোক।"
তিনি যোগ করেন, "একটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে তা সরাসরি ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের রাজস্বে অবদান রাখে, তাই আরও কোম্পানিকে উৎসাহ দেওয়া উচিত।"
এদিকে, ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ ও অন্যান্য ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ও পণ্যের আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার, যাতে চিকিৎসা সেবা আরও সুলভ হয়।
এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির ওপর আমদানি শুল্ক কমানোরও পরিকল্পনা রয়েছে।
এই উদ্দেশ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনটি বিদ্যমান এসআরও’র আওতায় ৭৯টি নতুন পণ্য করমুক্ত তালিকায় যুক্ত করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রস্তাবে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ২৩টি কাঁচামাল, অন্যান্য ওষুধের জন্য ৩৬টি কাঁচামাল এবং ওষুধ খাতে ব্যবহৃত ২০ প্রকার যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তারা জানান, ক্যান্সার ওষুধ তৈরির জন্য নতুন ২৩টি কাঁচামাল অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত ড্রাগ প্রশাসনের সুপারিশের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে।
এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে: ফোস্টামাটিনিব, ডিউক্রাভাসিটিনিব, পেফিসিটিনিব হাইড্রোব্রোমাইড, পোভোরসিটিনিব, ইভারমাসিটিনিব, রিলজাব্রুটিনিব, মোমেলোটিনিব, লেভোলিউকোভোরিন, গ্যানসাইকলোভির, টেজেপেলুমাব এবং ফারিসিম্যাব—যেগুলো ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া, ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রয়োজনীয় ট্যাঞ্জেনশিয়াল ফ্লো ফিলট্রেশন (টিএফএফ) সিস্টেমের জন্য একটি পৃথক এইচএস কোড চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে মাত্র ১ শতাংশ শুল্কে এটি আমদানি করা যায়।
ল্যাবএইড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ.এম. শামীম বলেন, যদি সরকার রেফারেল হাসপাতালের সুবিধা সব হাসপাতালে সম্প্রসারণ করে, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের গ্লোবাল বিজনেস ডেভেলপমেন্টের সিইও মনজুরুল আলম বলেন, "আমরা বর্তমানে বিদ্যমান এসআরও সুবিধায় কাঁচামাল করমুক্ত আমদানি করি। সরকার যদি তালিকা সম্প্রসারণ করে, তাহলে ওষুধ উৎপাদনের খরচ কমবে।"
এছাড়া, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ কমিশনে উৎসে কর (টিডিএস) হ্রাসের পরিকল্পনা করেছে। বর্তমানে এই হার ১ শতাংশ, যা অর্ধেকে কমিয়ে ০.৫০ শতাংশ করা হবে।
এই হ্রাসকৃত হার স্থানীয় এলসি’র মাধ্যমে আমদানি বা সরবরাহকৃত চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, ডাল, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ভুট্টা, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, গোলমরিচ, দারুচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, কম্পিউটার, কম্পিউটার এক্সেসরিজ ও সব ধরনের ফলমূলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
আয়কর ছাড় সীমা বৃদ্ধি: সরকার ব্যক্তি করদাতার জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৩.৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৭৫ লাখ টাকা করার চিন্তা করছে। তবে পরবর্তী স্ল্যাব ১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩.১০ লাখ টাকা করা হবে এবং এর উপর করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, করমুক্ত আয়সীমা নারীদের জন্য ৪.২৫ লাখ, প্রতিবন্ধীদের জন্য ৫ লাখ এবং গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৫.২৫ লাখ টাকা হবে।
পরবর্তী করস্ল্যাব অনুযায়ী: পরবর্তী ৪ লাখ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, এরপরের ৫ লাখে ২০ শতাংশ, তারপরের ৫ লাখে ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ কর ধার্য করা হবে।
প্রথমবার রিটার্ন দাখিলকারীদের জন্য ছাড়: নতুন করদাতাদের জন্য সুখবর হলো, বাজেটে আয়কর আইনে একটি ধারা যোগ করে প্রথমবারের মতো রিটার্ন দাখিলকারীদের জন্য ন্যূনতম কর ১ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে অন্যান্য করদাতাদের জন্য ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা থাকবে।
পার্কুইজিট করছাড় সীমা বৃদ্ধি: বর্তমানে এই সীমা ১০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের কর ছাড়: বর্তমানে মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ অথবা ৪.৫ লাখ টাকা (যেটি কম) করমুক্ত। এই ছাড় বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে বলেন, "নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে উৎসে কর কমানো ভালো উদ্যোগ, তবে পণ্যের তালিকাটি আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। পার্কুইজিট ছাড় বাড়ানোও যথার্থ পদক্ষেপ, যেটি উচ্চ আদালতের দ্বৈত করের বিষয়ে ইতিমধ্যে মন্তব্যের প্রতিফলন এবং ব্যবসায়ীদের জন্য করের বোঝা কমাবে।"
তবে দ্বিতীয় করস্ল্যাবের ১ লাখ টাকার ধাপ বাদ দিলে স্বল্পআয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "করমুক্ত সীমা বাড়লেও অনেকের জন্য অতিরিক্ত ২ হাজার ৫০০ টাকা কর দিতে হতে পারে।"