প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছেন ময়মনসিংহের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৯৯ সালে সেই শহীদদের স্মরণে বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতুর কাছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন শহরের ব্রহ্মপুত্রের তীরে পাটগুদাম এলাকায় নির্মাণ করেছে ‘ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ।’
সে সময় এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল অর্ধকোটির ( প্রায় ৫৬ লাখ) বেশি টাকা। এই স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রে রয়েছে একটি রাইফেল। ৫০ ফুট উঁচু স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে আছে মশালের আকৃতিতে। সৌধটিতে ২৬টি রাইফেলের উন্মুক্ত বেয়নেটের ওপর রয়েছে ফুটন্ত শাপলা। শাপলার নিচেই রয়েছে ১৯৭১ সালের স্মরণে ৭১টি ত্রিকোণ আকৃতির প্যানেল। কিন্তু ১৭ কোটি বাঙালির আবেগ ও সম্মানের এই স্মৃতিসৌধটি রয়েছে অযত্ন-অবহেলায়, পরিণত হয়েছে পাখির বাসা হিসেবে। এমনকি ভেঙে পড়ছে স্মৃতিসৌধের ৭১টি প্যানেলের অংশগুলো।
প্রধান ফটক পেরোলেই দেখা যাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নামফলক। ২০১৫ সালের দিকে স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকের পাশের সীমানা প্রাচীরের বেশ কিছু অংশ ভেঙে যায়।ভাঙা অংশটি মেরামত না করায় সীমানা প্রাচীরের রড ও অ্যাঙ্গেল চুরি হতে থাকে। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে বর্তমানে স্মৃতিসৌধের অর্ধেকের বেশি অংশেই সীমানা প্রাচীর নেই। যে কারণে স্মৃতিসৌধটি অরক্ষিত অবস্থায় এখন।
সীমানা প্রাচীর না থাকায় গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ, পশুপাখির বিষ্ঠা আর মানুষের মলমূত্র ত্যাগের ফলে স্থানটির বাতাসে এখন দুর্গন্ধ। নিয়মিত বসে নেশাখোর ও জুয়াড়িদের আসরও।
স্থানীয় বাসিন্দা রকিব হোসেন বলেন, “আন্তঃজেলা বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন স্মৃতিসৌধে রাতদিন বখাটে নেশাখোররা মাদকদ্রব্য বেচাকেনা করে, নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে। পরিবেশ ভালো না থাকায় এবং হয়রানির ভয়ে দর্শনার্থীরাও এখন আর স্মৃতিসৌধ দেখতে আসেন না। অনেকটা ভয়ের রাজত্ব চলছে জায়গাটিতে। পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতি না থাকায় রাতের বেলা এখানে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয় বখাটেরা।”
স্মৃতিসৌধের এমন বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় এলাকাবাসী। স্মৃতিসৌধের মূল বেদীর চারদিকের চারটি দেয়ালের চার রকমের সৌন্দর্যও নেই আগের মতো।সৌধের যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা।
নির্মাণের সময় স্মৃতিস্তম্ভটিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এবং ৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
স্মৃতিসৌধ দেখতে আসা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুনতাসীর মারুফ আসিফ বলেন, “দেশের সূর্য সন্তানদের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধটিতে গরু -ছাগলের বিচরণ অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। এলাকার আশপাশের রাস্তাগুলোর সংস্কার না হওয়ায় স্মৃতিসৌধের ভেতর দিয়ে অবাধে চলাচল করছে জনসাধারণ। এমনকি চলাচলের সুবিধার জন্য সৌধের দেয়াল ভেঙে করা হয়েছে যাতায়াতের রাস্তা। নিয়মিত ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনাও। স্মৃতিসৌধটি নিয়মিত পরিষ্কার না করায় আবর্জনা এবং মলূত্রের দূর্গন্ধ সব সময় থাকে।”
শুরুতে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ছিল পাটগুদাম এলাকার এ জায়গাটি। কয়েক বছর ধরে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ কেউ-ই জায়গাটির তত্ত্বাবধানে নেই। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে সৌধটি ।
স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল সংগ্রাম, আন্দোলনে ময়মনসিংহবাসীর ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের বীর সন্তানদের গৌরবান্বিত ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর লক্ষে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণকারী স্থাপনা। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতে স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হলেও বছরের অন্যান্য সময় এগুলো থাকে অবহেলিত, হয় না সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ। এতে স্মৃতিসৌধের পবিত্রতা, ভাবগাম্ভীর্য, পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হচ্ছে।