
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :

ঢাকার সকাল। সূর্যের আলোয় চকচক করে ওঠে রঙ-বেরঙের পলিব্যাগ, বোতল, স্ট্রো, মোড়কের পাহাড়। রাস্তার মোড়ে জমে থাকা প্লাস্টিকের স্তূপে কুকুর খাবার খুঁজছে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ কাপড় দিয়ে নাক চেপে ধরছে। শহরের কোটি মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপে এখন প্লাস্টিক এতটাই অনিবার্য হয়ে উঠেছে যে তার অনুপস্থিতি কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু এই নির্ভরতার ভেতরেই আছে গভীর বিপদ, শহর যেন ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বহীনতার দিকে এগোচ্ছে।
প্লাস্টিকের অদৃশ্য বেড়াজাল
বাজার থেকে শুরু করে খাবারের প্যাকেজিং, অনলাইন ডেলিভারি, পানির বোতল কিংবা ঘরের নিত্য ব্যবহারের জিনিস সবকিছুতেই প্লাস্টিকের প্রভাব চোখে পড়ে। বাংলাদেশে প্রতিদিনই কয়েক হাজার টন প্লাস্টিকের বর্জ্য তৈরি হয়, যার বড় অংশই পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। শহরের প্রতিটি অলি-গলিতে, ফুটপাথে, ড্রেনে প্লাস্টিক এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যেন তা শহরের নিত্যসঙ্গী।
মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করার নামে প্লাস্টিক যেমন সুবিধা দিয়েছে, তেমনি অজান্তেই তৈরি করেছে এক অদৃশ্য শৃঙ্খল, যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। প্লাস্টিকের সস্তা দাম, সহজলভ্যতা ও বহুমুখিতা; সব মিলিয়ে মানুষ ধীরে ধীরে অন্য বিকল্প ভুলতে বসেছে।
শহরের ফুসফুস বন্ধ করে দিচ্ছে পলিথিন
ঢাকার বড় সমস্যার একটি হলো ড্রেনেজ সিস্টেম। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টি হলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূলে রয়েছে পলিথিন ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়ংকর জমাট। ড্রেনের পানি নামার পথ সরু করে দেয় প্লাস্টিক বর্জ্য, ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকে রাস্তা ও ঘরের ভেতর।
এই জলাবদ্ধতা শুধু ভোগান্তিই নয়, বরং রোগবালাই ছড়ানোর অন্যতম কারণ। ময়লা প্লাস্টিকে ভরা স্থির পানিতে জন্ম নেয় ডেঙ্গু-বাহিত এডিস মশা। অর্থাৎ প্লাস্টিক শুধু পরিবেশ দূষণ নয়, মানুষের জীবনহানিকেও ত্বরান্বিত করছে।
নদীর দেহে প্লাস্টিকের ক্ষতচিহ্ন
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ঢাকার নদীগুলোর জলপ্রবাহ আজ বিপন্ন। প্রতিদিন হাজার হাজার টন কঠিন বর্জ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্লাস্টিক। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে মনে হয় নদী নয়, যেন নোনাধরা এক ফেলে দেয়া মাঠ। পানির নিচে থাকা মাছ, শামুক, কাঁকড়া, উদ্ভিদ; সবাই আক্রান্ত হচ্ছে প্লাস্টিকের বিষে। কেউ খাবার ভেবে গিলে ফেলছে ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক, কেউ জড়াতে গিয়ে হারাচ্ছে জীবন। নদীই যখন শহরের শিরা-উপশিরা, তখন সেই শিরায় বিষ ঢুকে গেলে পুরো শরীরই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঢাকাও এখন সেই অবস্থায়।
প্লাস্টিকের বিষ মানুষের শরীরেও
অনেকেই মনে করেন, প্লাস্টিক বাইরে থাকুক, মানুষের দেহে ঢোকে না। বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর। বাজারের মাছ, সবজি, এমনকি টিউবওয়েলের পানিতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে রক্তে মিশে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলো মানুষের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, কিডনি, লিভার এবং স্নায়ুতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। শহর যখন প্লাস্টিকে নিমজ্জিত, তখন মানুষও ভেতর থেকে এই দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে।
কেন বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার?
ঢাকায় দ্রুত নগরায়ন, ব্যস্ত জীবনযাত্রা, অনলাইন শপিং, খাবার ডেলিভারি; সব মিলিয়ে প্লাস্টিকের বিকল্প কমে এসেছে। এর সঙ্গে আছে সচেতনতার অভাব। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে পলিব্যাগ না নিলে অসুবিধা হয়, সবজি মোড়ানোর জন্য সহজলভ্য উপকরণ নেই, বাসায় পানি কিনতে হলে প্লাস্টিক বোতলেই নির্ভর করতে হয়।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও সস্তা হওয়ার কারণে প্লাস্টিককেই বেছে নেয়। আরেকটি বড় সমস্যা হলো কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব। প্লাস্টিকের বড় অংশই ডাম্পিং সাইটে না গিয়ে রাস্তায়, খালে, নদীতে পড়ে থাকে।
তবে কি কোনও আশা নেই?
এক কথায়, আছে। তবে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শহর পরিকল্পনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, এবং জনগণের অংশগ্রহণ।
বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং: খাবারের প্যাকেট, ডেলিভারি বক্স, শপিং ব্যাগ; সবকিছুর জন্য জৈবঘটিত বিকল্প ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
রিসাইক্লিং অবকাঠামো শক্তিশালী করা: প্লাস্টিক সংগ্রহ, বাছাই ও পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রগুলো আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে আপডেট করা যেতে পারে।
ইনসেনটিভ ভিত্তিক ব্যবস্থা: প্লাস্টিক বোতল ফেরত দিলে নগদ অর্থ বা পয়েন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে মানুষ উৎসাহিত হবে।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা: স্ট্রো, চামচ, পলিব্যাগ, প্লাস্টিক প্লেট; এসব ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ করা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য কমবে।
শহর কি বাঁচতে চায়?
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে যে এই শহর শুধু কংক্রিট নয়; এটি কোটি মানুষের স্বপ্ন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভবিষ্যৎ। প্লাস্টিকে ঢাকা নগর মানে শুধুই দূষণ নয়, বরং মানুষের বেঁচে থাকার বিপদ সংকেত। আমরা যদি এখনই থামতে না পারি, তবে একসময় হয়তো শহর নিজেই থেমে যাবে।
ঢাকা আজ এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্লাস্টিকে ডুবে থাকা এই শহর কি এখনও বেঁচে আছে, নাকি মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে? উত্তর নির্ভর করছে আমাদের সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ওপর। শহরকে বাঁচাতে হলে এখনই সময় প্লাস্টিকের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার।
mahmudnewaz939@gmail.com

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.