প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
বর্তমানে পৃথিবীতে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ বয়সসীমা সাধারণত ৮০-৯০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ একটি কচ্ছপের জীবনকাল ১৫০-২০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ২০০৬ সালে ওশান কোহোগ নামে এক ধরনের সামুদ্রিক শামুকের সন্ধান পান যেটির বয়স ছিল ৫০৭ বছর। অন্যদিকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণী হিসেবে পরিচিত গ্লাস স্পঞ্জের আয়ুষ্কাল প্রায় ১৭ হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
দীর্ঘজীবী প্রাণীদের বাইরে রয়েছে কিছু ক্ষণজীবী প্রাণীও। যেমন, পোকা-মাকড় কিংবা কীটপতঙ্গের আয়ুষ্কাল সাধারণত কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।
এসব তথ্য শুনে মনে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে এই প্রাণীজগতে প্রাণীভেদে আয়ুষ্কাল ভিন্ন ভিন্ন হয় কেন? এটি কি শুধুই একটি প্রাকৃতিক নিয়ম নাকি এর পেছনেও লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের কোনো জটিল হিসাব-নিকাশ?
বিজ্ঞান মানে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ। সুতরাং এই পৃথিবীর বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করলে হয়তো পাওয়া যাবে এই প্রশ্নের উত্তর। যেহেতু বিজ্ঞান কখনও থেমে থাকে না, বরং প্রতিনিয়ত নব দিগন্ত উন্মোচন করে মানুষের জানার পরিধিকে বিস্তৃত করাই এর কাজ, তাই গবেষণা এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কোনো প্রাণীর আয়ুষ্কাল নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে কাজ করে তার বিপাক প্রক্রিয়া বা মেটাবোলিজম। বিপাক প্রক্রিয়া হলো প্রাণীদেহের সকল রাসায়নিক কার্যকলাপের সমষ্টি যার মাধ্যমে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা উপাদানগুলোকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করা হয় এবং তারপর সেই শক্তির সাহায্যে প্রাণীদেহের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
প্রাণীভেদে বিপাক প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আর তাই তো একজন ব্যক্তির বিপাক ক্রিয়ার সাথে একটি হরিণ কিংবা মুরগির বিপাক ক্রিয়ার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
যে প্রাণীর বিপাক প্রক্রিয়া যত বেশি ধীরগতির হবে সেই প্রাণীর আয়ুষ্কাল তত বেশি হবে। অন্যদিকে বিপাক প্রক্রিয়া যদি দ্রুত হয় তাহলে উক্ত প্রাণীর আয়ুষ্কাল তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে। আর তাই তো মানুষ অপেক্ষা কচ্ছপ কিংবা তিমির আয়ুষ্কাল বেশি হয়ে থাকে। কারণ এসব প্রাণীর বিপাক প্রক্রিয়া মানুষ অপেক্ষা ধীরগতির।
একটি প্রাণী কতদিন বাঁচবে সেটি নির্ধারণ করতে তার শরীরিক বৃদ্ধির হার কেমন্এন তার ওপর। সাধারণত যেসব প্রাণীর বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয় তাদের আয়ুষ্কাল কম হয়ে থাকে। অন্যদিকে যেসব প্রাণী অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শারীরিক বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায় তাদের জীবনকাল কিছুটা দীর্ঘ হয়ে থাকে।
এর একটি ভালো উদাহরণ হিসেবে কচ্ছপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। শুধু চলনেই নয়, বরং শারীরিক বৃদ্ধিতেও কচ্ছপ বেশ ধীর গতির।
আর তাই তো তাদের আয়ুষ্কালও মানুষের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। অনুকূল পরিবেশ পেলে একটি কচ্ছপ প্রায় ২০০ বছর কিংবা তারও বেশি বেঁচে থাকতে পারে।
এছাড়া অভিযোজন ক্রিয়ার দিক থেকেও প্রাণীর আয়ুষ্কাল অনেকাংশে নির্ভর করে। কারণ একটি প্রাণী যেই পরিবেশে জীবনযাপন করবে সেখানকার পরিবেশ তার জন্য কতটা অনুকূল সেটি ঐ প্রাণীর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
যেমন- কোনো জায়গায় যদি শিকারি প্রাণীর সংখ্যা অত্যধিক হারে বেড়ে যায় তাহলে অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রাণীটির অস্তিত্ব সহজেই বিলীন হয়ে যাবে।
শারীরিক সামর্থ্যের দিকটিও এক্ষেত্রে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা যায়। কারণ, কোনো প্রাণী যদি শারীরিক দিক থেকে শক্তিশালী হয় এবং তার সাহায্যে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে তাহলে উক্ত প্রাণীর টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে যা তার আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম আয়ুষ্কাল নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। সাধারণত যেসব প্রাণী অতিরিক্ত পরিশ্রম করে তাদের গড় আয়ু কম হয়ে থাকে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রম করা প্রাণীদের আয়ুষ্কাল অন্য প্রাণীদের চেয়ে কিছুটা বেশি।
প্রাণীর আয়ুষ্কাল নির্ধারণে আবহাওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শীতপ্রধান অঞ্চলে শরীরের কোষগুলো গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের চেয়ে ধীরগতিতে কাজ করে। আর তাই শীতপ্রধান অঞ্চলে প্রাণীদের গড় আয়ু কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। আবার যেসব জায়গায় ঠান্ডার পরিমাণ বেশি সেসব জায়গায় মশাবাহিত কিংবা অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। আর এসব কারণেও সেসব অঞ্চলের প্রাণীদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পায়।