Bangla
a year ago

সায়ানোটাইপিং: সূর্যের আলোয় ছবি ছাপানো

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

ঘুরে আসা যাক সেই সময়টা থেকে, যখন ক্যামেরা ছিল না, কিন্তু মানুষের ইচ্ছে ছিল ছবি তোলার কিংবা হবহু কোনো বস্তুর নকল তুলে সংগ্রহ করার। তবে মানুষ তার কিছু কিছু ছবি এঁকে সংরক্ষণ করলেও সেই নকল তোলার স্পৃহা থেকেই যেত। সেই থেকে জন্ম প্রাকৃতিক নীলনকশার বা সায়ানটাইপিংয়ের। 

শুধু সূর্যের আলোতেই হয়ে যাবে ছবি ছাপা, দারুণ না ব্যাপারটা? অতি বেগুনি রশ্মির সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে মন মতোন ছবি হয়ে যাবে অতি সহজেই কিছু একরঞ্জনকারক পদ্ধতি ব্যবহার করে। 

সূর্যের আলো ব্যবহার করে এক রঙা ছবি বানানো যায় দুটো উপায়ে। একটির নাম সায়ানটাইপিং আর অন্যটি আন্থোটাইপিং।

গ্রিক ভাষায় সায়ান শব্দের অর্থ নীল। সায়ানোটাইপে নীল জমিনে ফুটে ওঠে ছবি বা নকশা। সাধারণত সায়ানটাইপে কোনো ভারী কাগজের ওপর প্রাকৃতিক বস্তু যেমন ফুল-পাতা বা ঝরা পালক চেপে রেখে তার অবিকল নকশা ধরে রাখা আর ছবিটা একরঙা বা শুধু নীলের ওপর হয়। কাগজের রসায়ন নিজেকে মেলে ধরে সূর্যের কাছে নীল রঙ ধরতে।

যখন একটা পাতাকে কাগজে ঠেসে ধরা হয় তখন পাতার বিপরীত পাস আলো না পেয়ে সাদাই রয়ে যায়, কিন্তু তার চারপাশ ঠিকই রাজকীয় নীল আভা ধারণ করে। ইংরেজিতে যে ব্লু প্রিন্ট বা নীলনকশার ধারণা আছে, সেটি এসেছে সায়ানোটাইপ থেকেই। এটাই ছিল ক্যামেরাহীন দিনে ছবি বের করার চমৎকার পন্থা।

এক কালের উদ্ভিদবিদরা কোনো পুরানো উদ্ভিদের রেকর্ড শতবর্ষ ধরে রাখতে এই পদ্ধতি কাজে লাগাতেন। বর্তমানে শিশুদের কাছে গরমের ছুটির বেশ জনপ্রিয় খেলা হয়ে গেছে এটি; তারা ফুল, পাতা, বীজ, পালক, প্রজাপতি, ছোট ঘাস, ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাদের ছাপ তুলে নেয়।

অনেক শিল্পী আছেন যারা চটকদার নীলের মোহমায়ায় এখনো শখের বশে সায়ানোটাইপ চর্চা করেই ছবি বানান। যারা জার্নাল বানাতে পছন্দ করেন, সায়ানটাইপিং তাদের কাছেও বেশ আকর্ষণীয়। 

দুটোভাবে সায়ানোটাইপিং করা যেতে পারে, আলাদা করে বাইরে থেকে কাগজে রঞ্জনকারক মেখে নিয়ে অথবা সরাসরি রাসায়নিক যুক্ত কাগজে।

প্রথম ক্ষেত্রে কিছুটা ভারী কাগজ চয়ন করতে হবে, তা হতে পারে কার্টিজ নয়তো জলরঙে হাতে বানানো যে পুরু কাগজ ব্যবহার করা হয় সেটি। এবার প্রয়োজন ফেরিক এমোনিয়াম অক্সালেট আর পটাশিয়াম ফেরি সায়ানাইড। দুটোই এক ভাগ করে নিয়ে খানিকটা জল মিশিয়ে নিতে হবে।

এবার মিশ্রণটি একটা ফোম বুরুশে ভরিয়ে কাগজের এক পাশে ভালো করে লাগিয়ে দিতে হয়। এরপর যেই ফুলটির বা পাতাটির ছাপ নেয়া হবে সেটি ভালোমতো কাগজের গায়ে আলতো করে সেঁটে দিয়ে একদম স্বচ্ছ কাঁচে চেপে ধরতে হয়।

এই কাজ খুব সতর্ক হয়ে এমন এক ঘরে করতে হবে, যেখানটা খুব অন্ধকার বা জানলা দিয়ে সূর্যরশ্মি ঢোকার সুযোগ নেই। কারণ আলো পড়লেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছাপ বসে যাবে। 

ব্যস! এরপরের ধাপ সূর্য্যিমামার কাছে। রোদ ভালো আসে এমন জানলার কাছে কিংবা বাহিরে খোলা আকাশের নিচে রেখে দিতে হবে কাঁচ আঁটা কাগজটি। রোদ ভালো পড়লে ঘন্টা দুই রেখে দিলেই কাজ সাড়া।

ধীরে ধীরে রঙ ফুটতে থাকবে, অক্সালেটের লৌহ অংশ কমতে শুরু করবে। প্রথমে হলুদ, হলুদ থেকে ফিরোজা, তারপরে রূপালী ধূসর, তারপরে সবুজ। এরপরে ধুয়ে নিলেই ফুটে ওঠে প্রুশিয়ান ব্লু। পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইডের জন্যে এই রঙ হয়। 

যদিও একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন এই ছাপ তোলার কাজে আর্দশ, একটু মেঘলা দিনেও তোলা যেতে পারে, তবে তাতে কমে আসবে নীল রঙের তীব্রতা আর সময়টাও বেশি লাগবে। তবে শিল্পীর যদি তাই কাম্য হয় তবে তাইতো সই, তার তো মেঘ দিনও জমজমাট। সময়ের তারতম্য আর আলোর তীব্রতার মাঝে কারসাজি ঘটিয়ে রসিক শিল্পী নীলনকশায় নানান শেডের জন্ম দেন। 

রঙ তো হলো, এবার ফটোগ্রাফের মতো ছবি ধোয়ার পালা। সাধারণ জলেই কাগজটাকে ভালোমতো ধুয়ে নিলেই হবে। যদি ধোয়ার জলে একটু লেবুর রস গুলে নেয়া যায়, তবে নীলটা আরেকটু খানি নীলাভ হবে। 

ধোয়া হলে শুকোনোর পালা। টাওয়াল কিংবা ভারী কাপড়ে কাগজটা বিছিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে; চোখে পড়বে ফুটফুটে রাজকীয় নীলের মাঝে কাঙ্খিত ছবিটি। 

এখন বাজারে রঞ্জক দেয়া কাগজ পাওয়া যায়, যাকে বলে সানোগ্রাফি কাগজ। ওতে সনাতনি পদ্ধতির মতো ঝঞ্ঝাট একটু কম, শুধু ওর ওপর পাতা গুলো রেখে কাঁচ বা স্বচ্ছ সেলোফোনে এঁটে ঝকঝকে সূর্যের আলোয় রেখে দিলেই কেল্লা ফতে। আজকাল সিল্ক বা কটনে করা হয় সায়ানটাইপ ডাই, পোশাকেও সেই নীলাভ ছোঁয়া। 

যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে কিংবা ক্ষারকের ছোঁয়ায় হলদে হয়ে যেতে পারে নীলাভ সূর্যছাপ। তাই এতে বাঁধানো ছবি বহুদিন ভালো রাখতে চাইলে ফ্রেমে বাঁধানোই শ্রেয়। 

বামে উদ্ভিদবিদ আনা এটকিন্স, ডানে তার প্রকাশিত ব্রিটিশ এলজি ভলিউম ১ এর কিছু অংশ 

এই একরঙা ছবি বানাবার পদ্ধতিটি কিছুটা ফিল্মের নেগেটিভের স্বাদ দেয়। চোখ ধাঁধানো এই সূর্য ছাপ স্যার জন হার্সেল আবিষ্কার করেন ১৮৪২ সালে। সেই সময়ের এক ইংরেজ নারী উদ্ভিদবিদ গোটা বই সাজিয়ে ফেলেছিলেন নিজের সংগ্রহ করা নানান শৈবাল, ফার্ন ও লতা-পাতার সায়ানোটাইপিং দিয়ে। আনা এটকিন্সের (১৭৯৯-১৮৭১) বৃহৎ সংগ্রহের প্রথম ভাগ 'ফটোগ্রাফস অফ ব্রিটিশ এলজি' পৃথিবীর প্রথম সায়ানটাইপ অলংকৃত বই। 

[email protected]

শেয়ার করুন