সিদ্দিক বাজার বিস্ফোরণ: ক্ষতিপূরণের ফোন কেউ কেউ পাচ্ছে, অন্যরা অপেক্ষায়

প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :

গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে নিহতদের স্বজনদের কাউকে কাউকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফোন করে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। তবে বেশিরভাগ পরিবার এখনও পায়নি সেই ফোন, যাদের মধ্যে কিছু পরিবার তাদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনকে হারিয়ে আছেন অসহায় অবস্থায়। সরকারের পক্ষ থেকে যে আর্থিক সহায়তা মিলবে, সে ধারণাও নেই তাদের কারও কারও মধ্যে।
গত ৭ মার্চের এ বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ২৫ জন। এদের মধ্যে এক পরিবারের সদস্য আছেন একাধিক। একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী, দুটি পরিবারের দুই ভাই, একটি পরিবারের দুই খালাত ভাই মারা গেছেন। ফলে পরিবারের সংখ্যা ১৯টি। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে ১০টি পরিবারে ফোন করে জানা গেছে, তাদের মধ্যে চারটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে ফোন করে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বাকি ছয়টি পরিবার এ বিষয়ে কিছুই জানে না।
শোকের ধাক্কা কাটিয়ে এখন প্রায় সবক’টি পরিবারই দুর্মূল্যের এ বাজারে টিকে থাকা নিয়ে লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাবা-মা হারিয়ে বৃদ্ধ দাদা-দাদির কাছে আশ্রয় হয়েছে দুটি শিশুর, দুই সন্তান হারিয়ে এক বৃদ্ধ মা শেষ জীবনে পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। একটি পরিবার তার স্বল্প আয়ের জামাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। বাবাকে হারিয়ে মা ও বোনকে বাঁচিয়ে রাখতে অপরিণত বয়সে চাকরি খুঁজছে এক কিশোর।
যারা মারা গেছেন, তাদেরকে স্বজনদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসন থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয় সমাহিত করার খরচ মেটাতে। তবে একজনের বিপরীতে টাকা মেলেনি এখনও।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, যারা মারা গেছে, তাদের স্বজনদেরকে দুই লাখ টাকা করে এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কিছু পরিবার ফোন পাচ্ছে, কিছু পরিবার এখনও কিছু জানে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “যাদের নাম তালিকায় আছে, তাদের সবার স্বজন পাবেন ধীরে ধীরে।”
তবে দোকান মালিকরা এই ক্ষতিপূরণ পাবেন না বলে জানান তিনি।
বিস্ফোরণ ঘটা ক্যাফে কুইন ভবনের পাশের একটি ভবনের ইউসুফ সেনেটারি নামে একটি দোকানের মালিক ছিলেন নুরুল ইসলাম। তিনি সেই ভবনের বাংলাদেশ সেনিটারিতে যেতে চেয়েছিলেন পাওনা টাকার খোঁজ নিতে। ভবনে ঢোকার আগেই ঘটে বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।
তার ভাই তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, তাৎক্ষণিকভাবে অনুদান পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকেও ফোন আসে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজনে ফোন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন নিহতের পরিবার দুই লাখ টাকা পাবে। বলেছিলেন, ‘চেক রেডি হলে যেন যাবেন’। তবে আর যোগাযোগ করেননি।”
নুরুলের তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছেলেটা এবার এসএসসি পাস করেছে, থাকে মায়ের সঙ্গে।
সেদিন ৭০ বছর বয়সী আকুতি বেগম মারা গেছেন মূল রাস্তা দিয়ে রিকশায় করে যাওয়ার সময়। তার স্বামী মারা গেছেন আগেই। নিঃন্তান এই নারী থাকতেন বংশাল এলাকায়। সেই ভবনের সামনে গিয়ে যাওয়ার সময় বিস্ফোরণে উড়ে আসা ‘চাকতির’ আঘাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।
তার খালাত ভাই শাহাজান সাজু জানান, মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় জেলা প্রশাসন থেকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপর একটি মন্ত্রণালয় থেকে ফোন এসেছিল। জানানো হয়েছে, একট চেক রেডি হচ্ছে। হলে আবার ফোন করবে তারা।
বাবা মমিনুল ইসলাম ও মা নদী বেগমকে হারিয়ে ১৪ বছর বয়সী ছেলে এবং ১১ বছর বয়সী একটি মেয়ে অনাথ হয়ে গেছে সেই বিস্ফোরণে। তাদের বাড়ি চক বাজারের ইসলামবাগ এলাকায়। এখন দাদা-দাদির আশ্রয়ে আছে দুই শিশু।
তাদের চাচা জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মমিনুল সিসি ক্যামেরার ব্যবসা করতেন। আর ঘর ভাড়ার আয়ে সংসার চলে যেত। এখন জীবন তাদের কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, শিশু দুটির দাদা-দাদিরও বয়স হয়ে গেছে।
এই দম্পতির জন্য তাৎক্ষণিক এক লাখ টাকা অনুদানের বাইরে গত ৯ মার্চ শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আরও কিছু কাগজপত্র তৈরি রাখতে বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে, দুই লাখ করে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে। তবে কবে সে টাকা দেওয়া হবে, সেটি জানানো হয়নি।
পুরান ঢাকার আলু বাজারের লুৎফর রহমান লেনে থাকতেন মো. ইসমাইল হোসেন। তার ভাই আব্দুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, তার বড় ভাইকে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
তারা ‘অনিশ্চয়তার সাগরে’
নুরুল ও আকুতির পরিবারের সংসার চালাতে আর্থিক চাপ অতটা নেই, যতটা সেদিন প্রাণ হারানো ইদ্রিস মিরের পরিবারের।
তিনি আজাদ সেনিটারি নামে একটি দোকানের ভ্যান চালক হিসেবে কাজ করতেন। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মো. রিফাত কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। ছোট ছেলের এখনও সব কিছু বোঝার বয়স হয়নি। কেবল প্রথম শ্রেণিতে পড়ে সে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রিফাত বলেন, “সংসারের কিছুই এখনও সেটিং হয় নাই। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু একটা করতে হবে, এটাই ভাবছি।”
সহযোগিতা কী পেয়েছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “জেলা প্রশাসন থেকে কিছু আর্থিক অনুদান পেয়েছিলাম।”
সেটি কত?
রিফাত বললেন, “৫০ হাজার।”
কেউ কেউ তো ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পাওয়ার বিষয়ে ফোন পেয়েছেন। আপনি পাননি?- এমন প্রশ্নে খানিকটা আশাবাদী কণ্ঠে তিনি পাল্টা প্রশান করেন, “আবেদন করলে কী কোনো লাভ হবে? আপনারা কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন?”
যাত্রাবাড়ীর মীর হাজিরবাগ এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকে ইদ্রিস মিরের পরিবার।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার চর বেউথা গ্রামে ওবায়দুল হাসান বাবুলের পরিবারও জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী?
ওবায়দুল এই মার্কেটের একটি দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন। তার দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ছেলের বয়স ১৮, পড়াশোনা করেন মাদ্রাসায়।
ওবায়দুলের বড় জামাতা চাতক সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংসার চালানোর মতো কেউ নাই। আমার একটা কাগজ কাটিং মেশিন আছে। সেটার আয় থেকে কিছু সহযোগিতা করি।”
ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানানো হলে তিনি বলেন, “ঢাকা লেবার সমিতি না কি থেকে জানি একবার ফোন দিছিল। (শ্বশুর) কী করত, না করত জানতে চাইছিল। আর তো কিছু বলে নাই।”
যে নম্বর থেকে ফোন করেছিল, সেটি কি আছে?-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “নাম্বার তো সেভ করি নাই।”

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.